অনিয়ম
মামুন রশীদ
ডিমের ঘাটতি ছিল।
সেই ঘাটতি পুষিয়েও উঠেছিলাম আমরা। ছেলেবেলায়, বিশেষত নব্বইয়ের দশকে যাদের বেড়ে ওঠা,
তাদেরও স্পষ্ট মনে থাকার কথাÑ বাড়িতে হঠাৎ যেদিন ডিম রান্না হতো, সেদিন ছিল পোলাও-মাংসের
মতোই উৎসব। কারণ, মা-কাকিরা সপ্তাহান্তে রান্নার জন্য সারা সপ্তাহ ডিম জমিয়ে রাখতেন।
তখন দেশি জাতের মুরগি এত উৎপাদনমুখী ছিল না। ফলে সপ্তাহান্তেই হতো ডিমের উৎসব। কখনও
কখনও ডিমের স্বল্পতা এবং পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় সেদ্ধ ডিম আলু অথবা বেগুনে
ঝোল করে রান্না হতো। কারও পাতেই যেন ডিমের অংশ কম না পড়ে সেজন্য ডিমের মাঝবরাবর সুতো
দিয়ে কাটা হতো। আর অসুখবিসুখে পাতে পড়া ধোঁয়াওঠা সেদ্ধ ডিমের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হলুদ
বা কমলা রঙের নরম কুসুমের স্মৃতি আজও জিভে জল এনে দেয়। ডিমের ঘাটতি মেটাতে পোল্ট্রি
খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন খামারিরা। পাঙ্গাশ মাছ, বয়লার মুরগি আর ডিমÑএ তিনে সব
শ্রেণির মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের সুযোগ তৈরি হয়।
পুষ্টির ঘাটতি
মেটাতে খামারিরা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এনে দেন ডিম ও ডিমের দাম। অথচ মধ্যস্বত্বভোগীদের
দৌরাত্ম্যে সেই ডিম নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও হাতের নাগাল ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাজারে
আলুর দামও বাড়তে বাড়তে মোটামুটি ৪৫ টাকায় স্থির। ফলে ডিমের সঙ্গে আলু সেদ্ধ ঝোল রান্নার
স্বাদও হারিয়ে যেতে বসেছে। সম্প্রতি একটা ডিমের দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকায় গিয়ে ঠেকে। গড়ে
১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মাসিক রোজগারের একজন অভিভাবক ১৪ টাকার একটি ডিম কীভাবে সন্তানের
পাতে দেবেন? পরিবারের অন্য সদস্যের পাতেই বা দেবেন কীভাবে? এও কিন্তু বড় প্রশ্ন হয়ে
দাঁড়িয়েছে, করোনার সেই কঠিন সময়েও যখন ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় এক ডজন ডিম মিলেছে, সেখানে
এখন কী এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে, এক ডজন ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।
প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও হিমশিম
অবস্থা। ফলে সন্তানের সামনে ডিম দেওয়ার সুযোগও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
খামারিদের দাবি,
মুরগি কমেছে। মুরগির খাবারের প্রধান উপকরণ সয়াবিন। তারও দাম বাড়ছে ফলে প্রভাব পড়ছে
বাজারে। খামারিদের এই দাবির সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুবই সতর্কতার সঙ্গে দেখা দরকার। বাজারে
প্রতিনিয়ত আমরা সিন্ডিকেটের কথা শুনি। সেই সিন্ডিকেট পোল্ট্রিশিল্পেও সক্রিয়। বেশ কয়েকজন
প্রান্তিক খামারির সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে জেনেছি, যে খামার তাকে লাভের মুখ দেখিয়েছে,
তা-ই এখন তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ ‘মুরগির খাবারের অস্বাভাবিক দাম এবং মুরগি বা ডিমের
দাম না পাওয়া’ যতটা, তার চেয়ে বেশি খামারে তার নিয়ন্ত্রণ হারানো। অধিকাংশ প্রান্তিক
খামারিকে মুরগির বাচ্চা, খাবার সরবরাহ করে পোল্ট্রিশিল্পের নিয়ন্ত্রকরা। খামারিদের
বড় অংশের কাজ শুধু মুরগি লালনপালন এবং ডিম উৎপাদনে সীমাবদ্ধ। খামার দেখভাল করার বাইরে
তাদের হাতে কিছু নেই। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক শিল্প মালিকদের হাতে রয়েছে মুরগি ও ডিম বিক্রির
দায়িত্ব। খামার দেখভাল করার জন্য খামারি পারিশ্রমিক পান। কিন্তু ব্যবসায়ে তার কোনো
প্রভাব নেই! খামারিদের হাত থেকে খামারের নিয়ন্ত্রণ কোন ফাঁকতালে বেরিয়ে গেছে, আমরা
কি তার তত্ত্বতালাশ করেছি?
গত বছর আগস্টে
ডিমের বাজারের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে ডিম আমদানি
করা হবে।’ কিন্তু সেই ‘প্রয়োজন’ কখন, তা এখনও অনিশ্চিত। সংবাদপত্রে প্রকাশ, ১৭ আগস্ট,
২০২৩ পোল্ট্রিশিল্পের নেতারা বলেছেন, ‘সরকার যদি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় তাহলে দেশের
পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংস হবে। আর এ শিল্প ধ্বংস হলে দেশের মানুষকে ২০ টাকা পিসে ডিম খেতে
হবে।’ আমদানি করলে প্রতিটি ডিমের দাম ২০ টাকা হওয়ার এই যে ভয়ের জুজু, তা কেন মেনে নেওয়া
হবে? মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে তো সাধারণ মানুষের পুষ্টির বিষয়টি জিম্মি থাকতে পারে না।
আমদানিকৃত ডিমের দাম যদি ২০ টাকাও হয়, তাহলে এর বিপরীতে খামারিরা যদি কম দামে দিতে
পারেন, তো মানুষ খামারিদের কাছেই ধরনা দেবে। আর চাহিদা যদি স্থানীয়ভাবে না-ই মেটানো
যায়, তাহলে জুজুর ভয় না পেয়ে বাজার উন্মুক্ত করাই ভালো। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সমস্যা
অন্তত মিটবে।
২০২২ সালের একটি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ১৩৬টি। সরকার ঠিক করেছে
এ সংখ্যাটি বাড়িয়ে ২০৩০ সালে ১৬৫তে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ সরকার চায় মাথাপিছু সব মানুষ
বছরে অন্তত ১৬৫টি ডিম খাবে। এ লক্ষ্যে আমাদের উৎপাদনসক্ষমতাও কিন্তু আশাজাগানিয়া। ২০২১-২২
অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয় মোট ২ হাজার ৩৩৫ কোটি। কিন্তু এই আশাজাগানিয়া ক্ষেত্রটিই
যখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াতে চায়, তখন বিকল্প তো ভাবতেই হবে। সেই সঙ্গে পেছনের কারণগুলোয়
নজর দিতে হবে। কেন ‘আমিষের সাশ্রয়ী উৎস’টি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে? কেন তা মানুষকে স্বস্তির
পরিবর্তে অস্বস্তিতে চাপা দিতে চাইছে? খামার থেকে একটি ডিম ভোক্তার হাতে আসতে কমপক্ষে
চার হাত ঘোরে। খামারি থেকে ডিম কেনে সরবরাহকারী বা এজেন্ট, তাদের থেকে আড়তদার, তাদের
থেকে পাইকারি দোকান, সেখান থেকে খুচরা দোকান। এ হাত ঘোরাঘুরিতে দেখা যাচ্ছে বঞ্চিত
হচ্ছে খামারিই। অন্যদিকে ভোক্তারও জেরবার হওয়ার দশা। মাঝ থেকে ফড়িয়াদের পোয়াবারো।
বাজারে আরও অনেক ক্ষেত্রেই এ অবস্থা বিরাজমান।