সম্পাদক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৪ এএম
সারা দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার যখন ঊর্ধ্বমুখী,
তখনও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধন কার্যক্রমে কদর্যতার ছায়া বিস্তৃত। বিষয়টি বিস্ময়কর,
যুগপৎ প্রশ্নবোধকও। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, সরকারি কিংবা কোনো কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে
কেনাকাটা মানেই যেন অনিয়ম-দুর্নীতির মচ্ছব। ১৯ আগস্ট প্রতিদিনের বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিবেদনটি
এরই সাক্ষ্যবহ। ‘মশার ওষুধে জালিয়াতি ঢাকতে জালিয়াতি’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের
গর্ভে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে প্রশ্ন জাগে, অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করতে অসাধুদের কসরত
কি চলতেই থাকবে? অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ডেঙ্গু কেন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং এই
পরিস্থিতির দায় কারÑ এ নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে
অগ্রভাগের কাজ হলো যেকোনো মূল্যে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নির্মূল করা। আর এজন্য
প্রয়োজন মশক নিধন ওষুধের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ক্ষেত্রটি ঘিরেই চরম দুঃসময়ে
জালিয়াতি জট পাকিয়ে উঠছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মশার ওষুধ আমদানিতে একের পর এক
ভয়াবহ জালিয়াতি সামনে আসছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মশক নিধন ওষুধ বিটিআই আমদানির
বিষয়টি অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে।
এই ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট সিঙ্গাপুরের যে
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম বলেছিল তারা তা অস্বীকার করেছে। তারপর প্রতিষ্ঠানটি চীনের
একটি কোম্পানিকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সামনে আনে। অথচ বিস্ময়কর হলো, এই কোম্পানির সঙ্গেও
সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটির ব্যবসায়িক কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের
কোম্পানিটি নিশ্চিত করেছে, তারা বাংলাদেশের কারও কাছে ৫ টন বিটিআই ওষুধ বিক্রি করেনি।
বাংলাদেশের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট জালিয়াতির জাল এমনভাবেই বিছিয়েছে,
এর পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি বেস্ট কেমিক্যালও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি
নিচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেও মশক নিধনের ওষুধ নিয়ে কাজ করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট। এই
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির জনৈক কর্মকর্তা ওষুধ জালিয়াতি সম্পর্কে প্রতিদিনের বাংলাদেশের
কাছে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি বৈ কিছু নয়। প্রতিদিনের বাংলাদেশের
প্রতিবেদনেই প্রকাশ পেয়েছে ২০১৯ সালে দরপত্র ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওষুধ কেনার
অভিযোগ উঠেছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সংকট পুঁজি করে
নিজেদের উদরপূর্তি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে স্বার্থান্বেষী মহল। করোনা দুর্যোগেও আমরা দেখেছি,
সংকট পুঁজি করে এরকম হীনচক্রান্তের শুধু জাল বুনেই স্বার্থান্বেষীরা ক্ষান্ত হয়নি,
জনস্বাস্থ্যগত সংকট পুঁজি করে আরও বহুরকম দুষ্কর্ম চালিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,
সেসব ঘটনার যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত হয়নি। আমরা মনে করি, প্রতিকারহীনতার বিবর্ণ ছায়া
গ্রাস করেছে এবারের সংকটেও। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যখন ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশক নিধনের
জন্য বিশেষভাবে তৎপর হওয়া উচিত, তখন এই কার্যক্রমের মূল উপকরণ যে ওষুধ ব্যবহার করে
আসছে উভয় সিটি করপোরেশন তা মানসম্মত নয় এবং আমদানিকৃত নতুন ওষুধ ঘিরেও জালিয়াতিÑ সংবাদমাধ্যমের
এমন খবরে সংগত কারণেই জনমনে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। আমাদের স্মরণে আছে, গত কয়েক বছর আগে
আইইডিসিআর গবেষণা জরিপ চালিয়ে দেখতে পেয়েছিলÑ ঢাকার উভয় সিটি করপোরেশনে যে ওষুধ ছিটানো
হয় তা একেবারেই অকার্যকর। বিষয়টি উভয় সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছিল আইইডিসিআর। এমন প্রেক্ষাপটে
এবার যখন মশক নিধনের ওষুধ নিয়ে ফের জালিয়াতির চিত্র উঠে এলো, তখন সংগত কারণেই সিটি
করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বও ফের প্রশ্নবিদ্ধ হলো। আমাদের প্রশ্ন, সিটি করপোরেশনে
ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যদি সিটি করপোরেশনের অসাধুদের অনৈতিক যোগসাজশ না
থাকে, তাহলে এমন কদর্য ঘটনা ঘটে কী করে?
ইতঃপূর্বে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা লিখেছিলাম, ডেঙ্গু ক্রমান্বয়ে
ভয়াবহ রূপ ধারণ করার নেপথ্যের কারণ হলো মশক নিধন কার্যক্রমের প্রক্রিয়ার মধ্যেই গলদ।
জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদরা এও জানিয়েছিলেন, বিশ্ব সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী মশক
নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। তাদের ওই পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য,
প্রতিবছর এডিস মশা ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বংশ বিস্তারের উৎস কিংবা কারণ নির্মূল
না করে ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী ব্যাধি প্রতিরোধ একেবারেই দুরূহ। আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত
কথা, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’। আমাদের বক্তব্য, প্রাণঘাতী ডেঙ্গু সংক্রমণ
ঊর্ধ্বমুখিতার পেছনে মশক নির্মূলের প্রধান উপকরণ ওষুধ নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ড ঘটছেÑ এই
দুর্নীতির দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার এবং প্রতিরোধ দুই-ই জরুরি।