× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনিয়ম-দুর্নীতি

তিতাসের সর্বাঙ্গে বিষপিঁপড়ার কামড়

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১১:১৯ এএম

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১১:২৮ এএম

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

‘তিতাসের বুকে আকাশের স্নান’ শিরোনামে কবিতাটি তিতাস নদীর পাড়ে বড় হওয়া কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন সেই কবে। তিনি লেখেন, ‘কিছুই খুঁজিনি আমি, যতবার এসেছি এ তীরে, নীরব তৃপ্তির জন্যে আনমনে বসে থেকে ঘাসে, নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক’। তারও অনেক আগে ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি লেখেন। সেখানে তিনি তিতাসকে চিত্রিত করেছেন এভাবেÑ ‘তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। …তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না। আজ হয়ত তারা শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্‌ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটি নদী।’

সেই স্রোতোস্বিনী তিতাস এখন মনুষ্যসৃষ্ট কারণে বিপন্ন। দখল আর দূষণের গাঢ় ছায়া! তিতাস নদী যেমন মনুষ্যসৃষ্ট কারণে বিপন্ন, তেমনি তিতাস গ্যাসও একই কারণে ক্ষতচিহ্নযুক্ত। তিতাস নদীর উপকূলে প্রাপ্ত গ্যাসক্ষেত্রটি তিতাস গ্যাসক্ষেত্র নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস উৎপাদনকারী ক্ষেত্র হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত এই গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি আবিষ্কার করেছিল। পরে গঠিত হয় গ্যাস কোম্পানি, যার নাম তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই কোম্পানি। যে লক্ষ্য নিয়ে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় এর মধ্যে অন্যতম প্রাকৃতিক গ্যাসের দক্ষ ও নিরাপদ বিতরণ, গ্রাহকদের উন্নত সেবা প্রদান, প্রাকৃতিক গ্যাসের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, গ্যাস বিপণনে সুশাসন নিশ্চিতকরণ। কিন্তু সব লক্ষ্যই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার উইপোকা কোম্পানিটিকে খাচ্ছে কুরে কুরে। তিতাসে যেন শুধু অনিয়ম-দুর্নীতির দহন আর দহন।

স্বল্পায়ু কবি আবুল হাসান তার ‘অগ্নি দহন বুনো দহন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘বুনো আগুনের ছোঁয়া দহনেই করেছি মাতম শুধু,/ পাপের মোড়কে দু’হাত ঢুকিয়ে পাখিদের আর তরু/ বীথিদের সাথে চারিয়ে দিয়েছি নৃশংস ডম্বরু/ মাটিতে মর্মে হায়রে এ কোন দহনের হলো শুরু...’। এই উদ্ধৃতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। আবুল হাসানের এই কবিতার পঙ্‌ক্তির সঙ্গে তিতাস গ্যাস কোম্পানিটির বিদ্যমান পরিস্থিতির অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। অনিয়ম-দুর্নীতির দহনে কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি দগ্ধ হচ্ছে, এরই চিত্র নিকট অতীতে উঠে এসেছিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। প্রতিদিনের বাংলাদেশেই স্বল্প দিনের ব্যবধান-এ তিতাস গ্যাস ফের নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ‘মিটারে বাড়াবাড়ি তিতাসে’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে সরকারি সেবা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির কদর্য চিত্র পুনর্বার উঠে এসেছে। দুদকসহ অন্য সরকারি সংস্থার তদন্ত ও সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে তিতাসের দুর্নীতিবাজদের অপকাণ্ড ইতঃপূর্বে বহুবার প্রকাশিত হলেও এর দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারের নজির বিরল। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনেই জানা গেছে, গ্যাসের অপচয় রোধে ৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস খাতে দক্ষতা উন্নয়ন এবং জলবায়ু প্রশমন প্রকল্প হাতে নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির আওতায় গ্রাহক পর্যায়ে একেকটি প্রিপেইড মিটার কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয় ২৯ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ চলমান একটি প্রকল্পে এমন মিটার কেনা হয় উল্লেখিত দামের অর্ধেকের চেয়েও কমে! একই জিনিস প্রায় দ্বিগুণ দামে কেনার প্রস্তাব দেওয়ার অন্তর্নিহিত রহস্য সচেতন যে কারোরই না বোঝার কারণ নেই। তিতাসের প্রিপেইড মিটার কেনার এই প্রস্তাবের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

বিগত আট মাসে শুধু প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ তিতাসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তিন পর্বের ওই ধারাবাহিক প্রতিবেদন বাদেও আরও অন্তত আটটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সংবাদমাধ্যমে একই সময়ে তিতাসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, এর কোনো কিছুই এই সেবা সংস্থার অসাধুদের দুষ্কর্ম ঠেকাতে পারছে না। তিতাসের সেবার মান নিয়ে আছে অন্তহীন প্রশ্ন। নিরাপত্তার বিষয়টি তো আরও কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তিতাসের সরবরাহ-সঞ্চালন লাইনের ত্রুটি-বিচ্যুতিও সর্বাঙ্গব্যাপী। রাজধানীর কয়েকটি এলাকাসহ নারায়ণগঞ্জে তিতাস গ্যাসলাইনে ত্রুটির ফলে সৃষ্ট ঘটনায় হতাহতের মর্মস্পর্শী অধ্যায় দূর অতীতের নয়। সেই ক্ষতের দাগ এখনও মুছে যায়নি। তিতাসের উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বিষপিঁপড়া অর্থাৎ অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কত, এ-ও অন্তহীন প্রশ্ন।

গত মার্চ মাসে তিতাসের প্রিপেইড মিটারে দুর্নীতির ফাঁদের চিত্র উঠে এসেছিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধানেই। ২০২১ সালে তিতাসকে দেওয়া চিঠিতে দুদকের পক্ষে উল্লেখ করা হয়েছিলÑ ৩০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানাবিধ দুর্নীতি, অবৈধ হস্তক্ষেপ, অনিয়মসহ নিজ ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়ের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হোক দ্রুত। কিন্তু সেই অনুসন্ধানের কোনো কিনারা মিলেছে কি না জানা নেই। তিতাসের দুর্নীতিবাজরা এতই শক্তিশালী যে, যত অভিযোগই থাকুক তারা খুব সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে! একদিকে গ্রাহক নিরাপত্তায় নেই তিতাসের কোনো আগ্রহ; অন্যদিকে বিলে ষোলো আনা, গ্যাসে ঠনঠনা! এ রকম বিড়ম্বনার আরও অনেক নজিরই আছে। আমরা জানি, সরকারি প্রকল্পে কেনাকাটা মানেই যেন দুর্নীতির মচ্ছব। কিন্তু তিতাসের ক্ষেত্রে এর পরিধি যেন আরও অনেক বিস্তৃত। গ্যাস বর্ণহীন বটে, কিন্তু সব গ্যাসই যেমন গন্ধহীন নয়, তেমনি নির্বিষ গ্যাস যেমন আছে, বিষাক্ত গ্যাসও আছে। তিতাসের ওই বিষপিঁপড়ারা যেন তিতাস গ্যাসের ভেতরের আরও বেশি বিষাক্ত গ্যাস।

তিতাস অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজরা শুধু অবৈধ সংযোগ দিয়েই নিজেদের উদরপূর্তি করে সরকারকে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছেÑ এই তথ্য জেনেছি, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলমের সঙ্গে কথা বলে। তিতাসের সেবা মানেই যেন দুর্নীতিবাজদের আখের গোছানোর অপকৌশল। সবকিছু জেনে মনে হয়, এ যেন ‘তাসের ঘর’। জীর্ণ লাইনের পাইপ ফেটে গ্যাস বেরিয়ে দুর্ঘটনায় নিভে যাচ্ছে মানবপ্রাণ, ঝলসে যাচ্ছে মানবদেহ। এত কিছুর পরও তিতাস গ্যাস তার নিজের দোষ খুঁজে পায় না! গাফিলতি ফুরায় না! তিতাসের খণ্ড খণ্ড অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাগুলোয় এও মনে হয়, এ যেন নিমজ্জিত হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া। ‘পুকুরচুরি’, ‘সাগরচুরি’ কিংবা ‘ওলট-পালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’Ñ এমন প্রবাদ যেন তিতাসের ক্ষেত্রে আর যথেষ্ট গণ্য বলে মনে হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তিতাস কি প্রতিকারহীনতায় জ্বলবে দহন জ্বালায়? তিতাসের দুর্নীতিবাজদের কালো হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা?

  • সাংবাদিক ও কবি
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা