× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গ্রেনেড হামলা

ঘটনাটি ভিন্নমোড় দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১৩:০০ পিএম

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

একুশে আগস্ট, স্বাধীন দেশে কলঙ্কিত একটি  দিন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেদিন বর্বরোচিত হামলা করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এমন পৈশাচিকতা-বর্বরতা কখনোই কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পরিচালিত ওই হামলার ভুক্তভোগী হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। হামলার লক্ষবস্তু ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনা। কিন্তু তার পাশে আরও অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। তারাও হামলার শিকার হন। কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন আবার কেউবা জীবিত থেকেও হামলার দগদগে ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন জীবন্মৃত অবস্থায়। হামলাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে এবং তাদের পাকড়াও করার পর আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। তৎকালীন সরকারের আমলে দৃশ্যমান হয় বিচারের নামে প্রহসন।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর্যালোচনায় কয়েকটি বিষয় আমাদের নজরে আসবে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে হামলার আগে বেশ কয়েকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হামলার নেপথ্যে তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিলÑ এমন অনুমান ভুল নয়। দ্বিতীয়ত, হামলায় আমরা জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। ওই হামলা প্রতিরোধের জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় ছিল না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা প্রতিষ্ঠান যেকোনো জঙ্গি তৎপরতা বা হামলা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, এটা খুব স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু তা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। কারও কারও মতে, ওই হামলা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনীহাও ছিল। এ অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ফলে হামলার পরিকল্পনাকারীরা সফলভাবে গ্রেনেড ছুড়তে পেরেছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বহু আলামত তৎকালীন সরকার নানাভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি তৈরি করে গ্রেনেড হামলার ঘটনাটিকে ভিন্নমোড় দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছিল। এসবই গুরুতর অপরাধ।

রাষ্ট্রশক্তি যখন এমন ভয়ংকর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে। অনিরাপদ এমন পরিস্থিতি জনগণের জানমালের জন্য হুমকির গুরুতর কারণ হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থা ভঙ্গুর করে তোলে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় ঘাটতি নজর এড়ায় না। ওই হামলাই প্রমাণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের অনাস্থা গড়ে উঠেছিল এবং সাম্প্রতিক সময়েও এর ধারাবাহিকতা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অনাস্থা এতটাই গভীরে শিকড় বিস্তৃত করেছে যে, এই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা আর সহজ নয়।

হামলার পর তদন্ত কার্যক্রম চালানো হয়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। হামলার জন্য যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনীর বলে অভিমত অনেকের। সঙ্গত কারণেই বিশ্লেষক বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রশ্ন করেন, সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারি এড়িয়ে কীভাবে এমন মারণাস্ত্র হামলাকারীদের হাতে পৌঁছেছিল। কিন্তু হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড সেনাবাহিনীর, এর পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য কিংবা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গ্রেনেড দেশের বাইরে থেকে আনানো হয়। হামলাকারীরাও আদালতে জবানবন্দিতে সে কথাই জানিয়েছে। মওলানা তাজউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ওই গ্রেনেড সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হামলার পরপরই তিনি পাকিস্তান পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। গোয়েন্দা বাহিনী এ বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারেনি। তা ছাড়া ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেভাবে বিন্যস্ত করা হয় তাতেও ঘাটতি ছিল। হামলাকারীরা যেন সহজে অনুপ্রবেশ করতে পারে, তার সুযোগ আগে থেকেই করা ছিল।

এমন যে কোনো ঘটনার পর রাষ্ট্রশক্তির কিছু সুনির্দিষ্ট ও জরুরি দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রথমত, হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযানে পাঠানো। কিন্তু তখন তেমন কিছু না করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয় এবং এর ফলে আতঙ্কিত মানুষ আরও দিশাহারা হয়ে পড়ে। দিশাহারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হামলাকারীরা সহজে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও কাউকে ধরতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যখন গাড়িতে করে ঘটনাস্থল দ্রুত ত্যাগ করছিলেন, তখন তার গাড়িবহরেও গুলিবর্ষণ করা হয়। অর্থাৎ হামলার পরও হামলাকারী সক্রিয় ছিল, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় ব্যর্থতা। তৃতীয়ত, কোনো হামলায় মানুষ আহত হলে তাদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। হামলার পর অনেককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে প্রস্তুতি ছিল না। জরুরি ওই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের যে তৎপরতা দেখানো উচিত ছিল, তার অভাব লক্ষণীয় হয়ে ওঠে সুস্পষ্টভাবে। ঘটনাস্থল পরবর্তীতে পানি ছিটিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়, যাতে তদন্তে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ না করা যায়। আবার এও দেখা গেছে, কিছু গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়নি। সেগুলোকে অকেজো না করে বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। কেন? প্রতিটি গ্রেনেডেই সামরিক চিহ্ন থাকে। গ্রেনেড উদ্ধার করা গেলে বোঝা যায় সেটি কোন দেশে বা কোথায় উৎপাদিত হয়েছে। চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই সাক্ষ্যগুলো ধ্বংস করা হয় এবং নিঃসন্দেহে এসবই অপরাধ।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ এসব সাক্ষ্য মুছে ফেলা হয়েছিল কেন। এ থেকেই আমাদের অনুমান করে নিতে হয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই ওই হামলা পরিচালিত হয়। এতদিনে ওই পৈশাচিক হামলার বহু তথ্যই আমাদের জানা। হামলাকারীরা কোথায় বসে পরিকল্পনা করেছে তাও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব স্থান ছিল খুবই স্পর্শকাতর। জঙ্গিদের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি এমনকি তৎকালীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। জঙ্গিদের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন আঁতাত রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। ক্ষমতাসীন দল, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং জঙ্গিÑ এই তিনের যোগসাজস রাষ্ট্রকে অনিরাপদ করে তোলে। জনজীবনে ত্রাসের সঞ্চার করে। দেশের রাজনীতিতে এখনও অনেকটা গোপনে এমন নেক্সাস জিইয়ে রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য শুভ কিছু হতে পারে না।

একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার প্রক্রিয়ার রায় নিম্ন আদালতে হয়েছে। এই মামলার বিচার কার্যক্রম উচ্চ আদালতে চলমান। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ অমসৃণ থাকে। জঙ্গিদের শাস্তির উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় তারা নানাভাবে এবং অনেকাংশে বিচ্ছিন্নভাবে এখনও অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনায় যুক্তদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হামলা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাষ্ট্রকে নিরাপদ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট হামলা। রাজনৈতিক স্বার্থের কারণেই পক্ষ-বিপক্ষ দলের অনেকেই এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখতে চান। কীভাবে এই হামলা পরিচালিত হয়েছে এবং কী কারণে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সে কথা মানুষকে জানাতে হবে।

উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এমন হামলার বিচার প্রক্রিয়া সামারি রিপোর্টের মাধ্যমে করা হয়। সামারি রিপোর্ট হামলার বিশদ বিবরণ নথিবদ্ধ করে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি সবার প্রথমে আসে বিধায় বিচার প্রক্রিয়াও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস থেকে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের উন্মুক্ত আদালতেই বিচার করা হয়। অনেক যুদ্ধাপরাধীই বিচারের রায় নিয়ে অভিযোগ তোলেন। কিন্তু উন্মুক্ত আদালতে রায় হয়েছে। উন্মুক্ত আদালতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের লোকই উপস্থিত ছিলেন। রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা গতি পায়নি। বিচারের প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারও দ্রুত নিষ্পন্ন করা যাবে। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র চাই। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা বাড়াতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সুসংহত করার মাধ্যমেই তা সম্ভব এবং বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল করার বিকল্পে নেই। 

  • নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা