নির্বাচন ও রাজনীতি
এম হুমায়ুন কবির
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৩০ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিদেশি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের আগ্রহ
বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মার্কিন মানবাধিকার সংস্থাগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগাদা
দিয়ে আসছে এবং বলছে এজন্য আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রোধে
কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। গত ১৫ আগস্ট কংগ্রেসনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন টম ল্যানটসে
বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ে নানা পর্যালোচনা করে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। অনেক দিন
ধরে দেশে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। তবে সাম্প্রতিককালে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে র্যাবের
ওপর স্যাংশন আরোপের পর। দুটি প্রেক্ষাপট মনে রাখলে পুরো বিষয়টি বোঝা সহজ হবে আমার
ধারণা। প্রথমত, বৈশ্বিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। সারা বিশ্বেই এখন অস্থিতিশীল
পরিবেশকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনের পর গণতন্ত্র
ব্যবস্থাপনার বিষয়টি হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে। আমরা দেখছি, কয়েক বছর ধরেই
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নিয়ে সংকট চলছে। এ সংকট এখনও তাদের জন্য নানা
সমস্যা তৈরি করে রেখেছে। সঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায়, বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও
মানবাধিকারকে বৈদেশিক নীতিমালার কেন্দ্রে রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের
নীতিমালা গড়ে তুলেছে। বাইডেন অফিসে বসার পর থেকে সারা বিশ্বেই মানবাধিকার ও
গণতন্ত্র আলাদা গুরুত্ব অর্জন করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং
অগণতান্ত্রিক বিশ্বÑ এ দুই ভাগে দেখার চেষ্টা করছে। যদিও এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে তবু
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের মাধ্যমে বৈদেশিক সম্পর্ক দেখার চেষ্টা করে চলেছে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে মার্কিনি দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবে রূপ দেওয়ার
জন্য তারা ইতোমধ্যে সম্মেলন করেছে। এটি মূলত বড় প্রেক্ষাপট। কিন্তু আমরা যদি
ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে বিষয়টি বিচার করতে যাই তাহলে দেখব, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার
সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ আচরণ যাদের নেই এবং মানবাধিকার বিষয়ে শঙ্কা রয়েছে এমন ছয়টি
দেশের (যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি) ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন আরোপ করে। স্যাংশন
আরোপের পরপরই আমরা এ বিষয়ে মনোযোগী হয়ে উঠেছি। সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক
দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে মানবাধিকারের ব্যত্যয় ঘটেছে এ অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন সংস্থার অনেকেই আমাদের দেশে কাজ করেন। তারা যেমন এ বিষয়টি উল্লেখ করেন,
তেমনি দেশের ভেতর সচেতন মহলের অনেকেইে আমাদের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অবকাঠামো
গড়ে তোলার তাগাদা দিয়ে আসছেন। কিন্তু বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এর
একটি কারণ সম্ভবত রাজনীতিকরা মনে করেন
রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে
এমন ভাবনার দরুন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এখনও আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নয়।
এগিয়ে
আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন কেন্দ্র করেই গণতন্ত্র ও
মানবাধিকারের বিষয়টি অনেক দিন ধরে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। বড় ও ক্ষুদ্রÑ এ দুটি প্রেক্ষাপট
নিয়ে আলোচনা করেছি। এ দুটি প্রেক্ষাপট থেকে যদি এবার টম ল্যানটসের বক্তব্য বিচার
করতে যাই, তাহলে বোঝা কিছুটা সহজ হবে। মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও
ডেমোক্র্যাটিকÑএ দুই রাজনৈতিক দলই কিন্তু বিষয়টিতে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কংগ্রেসে
মূলত ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের গণতন্ত্রের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু
কংগ্রেসনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের ব্রিফিংয়ে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলা
হয়নি। বরং অন্য কয়েকটি সংস্থাকে নিষেধাজ্ঞার অধীন নিয়ে আসার সুপারিশ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে
এটি বড় চিন্তার বিষয়। যদি সত্যিই নতুন কয়েকটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়,
তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
গণতান্ত্রিক
বিশ্বের অংশীজনেরা ইতোমধ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
কিছু কিছু দেশ এ ব্যাপারে সক্রিয়তাও দেখাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে যদি আমাদের ওপর নতুন
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। মনে রাখতে হবে,
মানবাধিকারের সঙ্গে ভোটাধিকার জড়িত। রাষ্ট্রের নাগরিক ভোট দেবে এও তার অধিকারের
অংশ। আগামী সংসদ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিগত
কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করেই বিতর্কের সূত্রপাত। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়
মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ, মৌলিক চাহিদা পূরণ, রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা নির্বিঘ্নে
পাওয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে
বলে আমার ধারণা এবং বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিষয়গুলো
অত্যন্ত জরুরি।
আমি
মনে করি, টম ল্যানটসের ব্রিফিং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণে গণতন্ত্রকে বিবেচনা
এবং তা বাস্তবায়নের একটি সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন, আচমকা কেন
তারা আমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে
কয়েকটি বিষয় উল্লেখ জরুরি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে
সম্ভাবনাময়। এই ইতিবাচক ধারণাটি বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্র যেমন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ভারত, চীনের রয়েছে। আমাদের সম্ভাবনা এ
রাষ্ট্রগুলো স্বীকার করে বলেই আমাদের প্রতি তাদের মনোযোগও অতীতের তুলনায় বেড়েছে। আমার
ধারণা, এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে কীভাবে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ও উপাদেয় করা যায় তা
নিয়েই বিদেশিরা ভাবিত। তা ছাড়া এ সম্ভাবনা টেকসই করে তোলার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে
হবে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সর্বজনগ্রাহ্য ও উপাদেয় করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব
হবে না। কারণ টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনা জরুরি। আর আমাদের উন্নয়নের গল্পের
সমান্তরালে বৈষম্য উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
দ্বারা প্রভাবান্বিত এমনটি নয়; বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেরও
ভূমিকা এখানে রয়েছে। রাজনৈতিক উপাদান হিসেবেও বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই অর্থনৈতিক
ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রত্যেকের জন্য গ্রহণযোগ্য, উপাদেয় ও সুষম বণ্টনমূলক করা
জরুরি। বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিশ্বের অনেক দেশই এখন ইতিবাচকভাবে দেখছে এবং আমার ধারণা,
তারা মনে করে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সুসংহত করার মাধ্যমে
তারা এ টেকসই উন্নয়ন করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল
গণতন্ত্রচর্চার অধিকার আদায়। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে
সঙ্গত কারণেই আমাদের সহযোগী রাষ্ট্রগুলো নানাভাবে সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক
অবস্থার কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিলেই তারা শঙ্কিত
হয়। এতদিন বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে আমরা অর্থনৈতিক সহযোগী বলে মনে করতাম। কিন্তু দেখা
যাচ্ছে, তারা অন্য অনেক বিষয়েও আমাদের সহযোগী ও পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করে
আসছে। কয়েক বছর ধরেই বিদেশিদের নানা ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। আর যেহেতু অতীতে
নির্বাচন ঘিরে অসংখ্য প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, তাই বিদেশি সহযোগী শক্তির অনেকেই আগামী
নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমন আশঙ্কা করে চলেছে। নির্বাচনী আয়োজন যদি সুষ্ঠু না
হয় তাহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনটি যেন না হয়
সেজন্যই সম্ভবত আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে তারা সক্রিয়।
আমাদের দিক থেকে অবশ্য আরও প্রশ্ন জাগ্রত হয়। বিদেশিরা আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত। তাদের কি এখানে কোনো স্বার্থই নেই? নাকি সহযোগী হিসেবে তারা আমাদের স্বার্থের কথাই চিন্তা করছে? অবশ্যই বিদেশিদের স্বার্থ রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একদিকে চীন ও রাশিয়া এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্র এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গেও আমাদের সংযুক্তির সুযোগ রয়েছে; তাই বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অতীতের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। বড় শক্তিরা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত সক্ষমতা গড়ে তোলার বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হতেই হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বড় ভূমিকা পালন করছে। স্বভাবতই বাংলাদেশের প্রতি অন্যান্য রাষ্ট্রের এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে। সেই প্রত্যাশার জায়গা থেকেই তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে বারবার বাংলাদেশকে নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকাংশে তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক বৈদেশিক নীতিমালার অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপের ঘোষণা দিচ্ছে। তবে আমরা যে একেবারে চুপ তা কিন্তু নয়। নিরাপত্তাবিষয়ক অনেক কিছু নিয়ে আমরা কাজ করছি। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, শিক্ষা ও সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো নানা পদক্ষেপ আমরা ইতোমধ্যে নিয়েছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সুসংহত করার ক্ষেত্রে আমাদের যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তাতে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান আমাদের করতে হবে।