তরুণ প্রজন্ম
সোনিয়া বিন জাফর
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৪৬ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
শিক্ষাব্যবস্থায়
ইতিবাচক বদল আনার কথা প্রায়ই বলা হয়। এই বদল আনতে হলে প্রথমে বিশ্বজুড়ে তরুণ প্রজন্মের
অসন্তোষ, বিক্ষুব্ধ ও প্রায়ই বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাকে নজরে আনতে হবে। সম্প্রতি
ফ্রান্সে তরুণদের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভাজন দেখা যাচ্ছে। বিভাজন কেন্দ্র
করে তরুণদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতার নজিরও কম নয়। আর তরুণ প্রজন্মের এই শান্তি ও শৃঙ্খলার
অভাব দূর করার বিষয়ে এখন থেকেই রাষ্ট্রকে মনোযোগী হতে হবে। বিক্ষুব্ধ, অশান্ত তরুণ
প্রজন্ম শুধু ফ্রান্সের সামাজিক পরিসরের সমস্যা তা নয়, গোটা বিশ্বেই তরুণরা সামাজিক,
রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নানাভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি
করছে। তবে পশ্চিমা গণমাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় ফ্রান্সের নাহেল, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ
ফ্লয়েড, তিউনিসিয়ার মুহাম্মদ বুয়াজিজির নাম আমাদের সামনে এসেছিল। সামাজিক পরিসরে মানুষের
মনে চাপা ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ এসব ঘটনার ভিত্তিতে পায়। আর ঘটনা সামান্য হলেও এসবের
পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরের বড় প্রভাব রয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের
বিক্ষুব্ধ ও বিশৃঙ্খল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পেছনে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের ভূমিকা একটু অনন্যই বলতে হয়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান শ্রেফ শেখার স্থান নয়। এখানে ব্যক্তি নিজের বিকাশ ও রূপান্তরের
নানা উপাদান খুঁজে পায় এবং তাকে ধারণ করে নিজেকে গড়ে তোলে কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
কিন্তু মানবিক ব্যক্তি হিসেবে। তরুণ প্রজন্মকে জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয়
জ্ঞান সরবরাহের পাশাপাশি তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন তা শেখাতে হবে।
যেকোনো দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথমে সমালোচনামূলক চিন্তাপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি
গঠনমূলক বক্তব্য গড়ে নিতে হয়। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাপ্রক্রিয়া
(ক্রিটিক্যাল থিংকিং) কীভাবে করতে হয় সে সম্পর্কে ধারণা আছে কম। ফলে সমস্যার সমাধান
না করে তারা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এ সমস্যা থেকে বের হতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়
পরিসরে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও যেন মনে না হয় তাকে
গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সচেতনদের দাবি—জানার আকাঙ্ক্ষা, সমস্যা, অভিযোজনের পরামর্শের মতো বিষয়গুলো
যেন সমান গুরুত্ব পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
তরুণ প্রজন্ম
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে ভোগে। অনেক সময় তারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্তেই তরুণ প্রজন্মের আত্মহত্যাপ্রবণতা একটি বড় সমস্যা। প্রক্রিয়াগত ঘাটতি
সমাজে কেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা এ সংকটের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক
এ ঘাটতির কারণেই তরুণরা গর্জে উঠছে। আর তাদের বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি, বিক্ষোভ ও চঞ্চলতা
নেতিবাচক এ কথা সত্য। কিন্তু শঙ্কিত তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইতিবাচক
পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। তাই তাদের নেতিবাচকতাকে দোষও দেওয়া যায় না। এ প্রজন্ম আর চুপ
করে থাকতে রাজি নয়। প্রচলিত কাঠামো বা ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতেও তাদের বাধে না। সংগঠক
ও রাজনীতিকদের তরুণ প্রজন্মের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাজনীতিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মূল
অনুসঙ্গ হোক বিষয়টি। তরুণ প্রজন্ম যেন নিজের সুতাটা ধরতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যই
তো তাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণ।
সংবাদমাধ্যমে
প্রতিনিয়ত বিক্ষোভের খবর দেখা যায়। উপায়ান্তর নেই দেখেই তরুণ প্রজন্ম বিক্ষুব্ধ হয়ে
ওঠে। তাদের ধারণা, এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তবে তরুণ প্রজন্মের দিশাহারা পরিস্থিতি নিরসনের
ক্ষেত্রে বিক্ষোভ কর্মসূচি কিংবা সেমিনারে বিশাল আলোচনা করে সমাধান পাওয়া যাবে না।
সংকট নিরসনে শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাব্যতা এবং কর্মসংস্থান গড়ে তোলার বিষয়ে মনোযোগ দিতে
হবে রাষ্ট্রকে। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈচিত্র্য এনে যখন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত
করা হবে, তখন একজন শিক্ষার্থী নিজের সম্ভাবনা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে। উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহারিক সমাধানের পথে এগোতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত
করে শান্তি, নিরাপত্তা এবং সুসমন্বিত জাতীয় উন্নয়ন কঠিন কিছু নয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
এ দায়িত্ব পালন করবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যখন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক বিষয়াদির সঙ্গে পরিচয় করানোর পরিবেশ গড়ে
তোলে, তখন কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা সমস্যার সমাধান করতে উৎসাহী হয়। এমন পরিবেশে
নেতৃত্বও গড়ে ওঠে। উচ্চশিক্ষা সব সময়ই শিক্ষার্থীদের জটিল সমস্যা। বিশ্লেষণ বোঝার জন্য
প্রয়োজনীয় রসদের জোগান দেয়। এখানেই তারা যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাপ্রক্রিয়ার চর্চা করে এবং
নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ পায়। বিশ্বের জনপ্রিয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের
শুধু ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের রসদ জোগান দেয় না, শিক্ষার্থীরা যেন সমাজে অবদান রাখতে
পারে সে বিষয়টিও তাদের মনে প্রোথিত করার চেষ্টা করে। উচ্চশিক্ষার তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার
সঙ্গে বাস্তবতার (নন-একাডেমিক) ব্যবহারিক কাঠামোর সমন্বয় করলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি
জ্ঞানের বিকাশের সুযোগসুবিধাও নিশ্চিত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, তরুণ প্রজন্মকে শিখতে আগ্রহী
করে তুলতে হবে। চাকরির বাজারের চাহিদা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বাস্তব দক্ষতা
অর্জনের জ্ঞানও দিতে হবে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ট্রান্সফরমিং এডুকেশন সামিট
শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের আবদুল্লা আল
ঘুরাইর ফাউন্ডেশন ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে শিক্ষাকার্যক্রমের উদ্যোগ
নিয়েছে। প্রায় ২ লাখ আরব শিক্ষার্থীকে উচ্চ চাহিদা রয়েছে এমন চাকরি পাওয়ার প্রয়োজনীয়
দক্ষতা অর্জনের পেশাদারি শিক্ষা দিচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ করতে হবে। বিশেষত যারা অন্তরালে থাকে তাদের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বাস্তবতার সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলে তারা হতাশ হবে না। প্রকৃত সমাজবাস্তবতা বুঝতে হলেবাস্তব জগতের সমস্যার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত করাতে হবে। যদি তা করা সম্ভব না হয় তাহলে তরুণ প্রজন্ম আরও সহিংস হয়ে উঠবে। আর তাদের সহিংসতার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দেবে।
আলজাজিরা থেকে
সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন