জি-২০ সম্মেলন
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৫০ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎÑ এই প্রতিপাদ্যকে উপজীব্য
করে আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতে অনুষ্ঠেয় হতে যাচ্ছে বিশ্বের শিল্পোন্নত এবং
উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অংশগ্রহণে জি-২০-এর ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন। ২০১১ সাল থেকে
জি-২০ সম্মেলন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জি-৭ দেশগুলোর বাইরে বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলোকে
আরও বৃহত্তর পরিসরে মোকাবিলা করতে ২০০৯ সালে জি-২০ সম্মেলনের সূত্রপাত। এই জোট
গঠনের পর থেকে অনেকের মধ্যে এই ধারণা কাজ করতে থাকে যে, ভবিষ্যতে জি-৭ভুক্ত
দেশগুলোর কর্তৃত্ব কমতে থাকবে এবং ক্রমাগতভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো বৈশ্বিক
পরিসর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বলা যায়, পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে রাশিয়া, চীন
এবং ভারতের অন্তর্ভুক্তি বৈশ্বিক জনসংখ্যা এবং জিডিপির বিবেচনায় এটিকে অনেকটা
গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ করে তুলতে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই রাশিয়া
কর্তৃক ইউক্রেনের ক্রিমিয়াকে নিজ ভূখন্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া
প্রাথমিকভাবে বড় ধাক্কার জন্ম দেয়।
শুরুতেই যে আস্থা এবং অঙ্গীকার নিয়ে এই জোটের যাত্রা শুরু
হয়, পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে প্রকারান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই বার্তাই দেওয়া
হয়, বিশ্বের নেতৃত্ব নিতে বৃহত্তর পরিসরে জোট আসলে সে রকমভাবে সক্ষম হয়ে উঠতে
পারেনি। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার তরফ থেকে ইউক্রেন অভিযান এবং
তা অদ্যাবধি চলমান থাকা, এর মধ্য দিয়ে জি-২০ভুক্ত কিছু দেশের মধ্যে নিজেদের
স্বার্থের হিসাব মেলানোর প্রয়াস এটির প্রতি বিশ্বের মানুষের আস্থাহীনতা অনেকটাই
বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধজনিত
কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফলে এই সম্মেলনে তার
অনুপস্থিতি যৌক্তিক, যেমনটা গত বছর ইন্দোনেশিয়া সম্মেলনের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তবে
এরই মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এবারের ভারত সম্মেলনে উপস্থিত না থাকার
ইঙ্গিত নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের প্রশ্নের সঙ্গত কারণও রয়েছে। চীন
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কতটুকু বৈশ্বিক অভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কাজ করতে
ইচ্ছুক, এটা নিয়ে অনেক দিন ধরে নানা সংশয়-সন্দেহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট শির যোগ না
দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অসহযোগিতার বার্তা দেয়।
এদিকে চীনের এই ঘোষণার পরপরই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সের্গেই ল্যাভরভ জানিয়ে দিয়েছেন, এই সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় যদি রাশিয়ার ইচ্ছার
প্রতিফলন না ঘটে, তবে তারা এতে বাধা দেবে। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট পুতিনের স্থলে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ রাশিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করবেন আর চীনের প্রেসিডেন্ট শির
স্থলে প্রতিনিধিত্ব করবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে,
চীনের প্রেসিডেন্টের না আসার আকস্মিক সিদ্ধান্ত এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
তরফে হুঁশিয়ারির মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে। কয়েক বছর ধরেই জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে
কিছু বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে মতানৈক্য দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত
বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমাতে চীনের অপারগতা, সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক
সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের পক্ষ থেকে অনেকটা সক্রিয়ভাবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে
পড়া। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেবল চীনই নয়, সেই সঙ্গে জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর
মধ্যে ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
মতানৈক্যের মধ্য দিয়েই সাম্প্রতিক সময়গুলো অতিবাহিত করছে জি-২০ভুক্ত দেশগুলো।
প্রত্যক্ষভাবে না হলেও কিছু সদস্য দেশ এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা
দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহকে ভালোভাবে দেখছে না। চীন তো শুরু
থেকেই স্পষ্টভাবে বলে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো একদিকে যুদ্ধের বিরোধিতা করছে,
অন্যদিকে রাশিয়াকে পরাজিত করতে জোটবদ্ধভাবে কাজ করছে। এর মধ্য দিয়ে জি-২০ জোটের
দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য অনেকটা স্পষ্ট হয়ে আসছিল।
জি-২০-এর বর্তমান চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছে ভারত। নিজ
দেশে অনুষ্ঠেয় ১৮তম সম্মেলনকে সফল করতে দেশটি বছরজুড়ে নানা কর্মতৎপরতা চালিয়েছে।
সদস্য দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে ৯টি দেশকে সঙ্গে নিয়ে সম্মেলনের
আলোচ্যসূচি ঠিক করা, বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। এই
সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের ৫০টি শহরে ৩২টি পৃথক কর্মধারার আলোকে দুইশর অধিক বৈঠক
অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। জি-২০-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত ঘোষিত ছয়টি অগ্রাধিকার হলোÑ জলবায়ু
পরিবর্তনসহ জলবায়ুবিষয়ক কার্যাবলি; অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক বিকাশ; টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অগ্রগতি ত্বরান্বিতকরণ;
প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার;
নারী নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন এবং সংশোধিত বহুপক্ষীয়তা। অনেক দিন ধরে
প্রস্তুতি নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এই সম্মেলনের আয়োজনে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে
চীনের প্রেসিডেন্টের যোগ না দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে, যদিও ভ্লাদিমির পুতিনের যোগ
না দেওয়ার বিষয়টি অনুমেয়ই ছিল। ঠিক কী কারণে প্রেসিডেন্ট শি এই সম্মেলনে যোগ
দিচ্ছেন না সেটার কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা চারটি বিষয়কে আলোচনা করতে পারি।
প্রথমত,
সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যে ছয়টি অগ্রাধিকারের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে
যদি এই সম্মেলন শেষে যে যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হবে, তাহলে এর কৃতিত্ব হবে
ভারতের, যা চীন চাইবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না চীন যেখানে আগামী দিনগুলোতে নিজেকে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, সেখানে ভারতের দিক
থেকে এ ধরনের প্রস্তুতি অনেকটা চীনের দিক থেকে এমন মনে হতে পারে যে এগুলো পশ্চিমা,
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত বিষয়। চীনের দিক থেকে
পশ্চিমা বিরোধিতা, রাশিয়ার অবস্থানের বিরুদ্ধে না যেতে অনমনিয়তা এবং সার্বিক
বিচারে রাশিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে এ বিষয়ে আলোচনায় নিজের অবস্থানকে
প্রতিষ্ঠিত করতে না পারার শঙ্কা প্রেসিডেন্ট শিকে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণে অনাগ্রহী
করে থাকতে পারে। তৃতীয়ত, সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাত্র ১২ দিন আগে চীনের তরফ থেকে নতুন
মানচিত্র প্রকাশ এবং সেখানে আকসাই চীন এবং অরুণাচল প্রদেশকে নিজ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত
হিসেবে দেখানোর ফলে ভারত এবং চীন এই দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক উত্তেজনা
বিরাজমান। এই অবস্থায় সঙ্গত কারণেই প্রেসিডেন্ট শি ভারতের নরেন্দ্র মোদির মুখোমুখি
হওয়া থেকে বিরত থাকতে চাইবেন। গত বছর বালিতে অনুষ্ঠিত জোটের সম্মেলন এবং কয়েক দিন
আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিলেও মূলত ভারতের মাটিতে
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে শি এবার যোগ দিচ্ছেন নাÑ এটা ভাবাটা মোটেও অমূলক নয়।
চতুর্থত, ব্রিকসে চীন যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে, জি-২০-এ
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে সে তুলনায় চীনের প্রভাব অনেকটাই
ম্লান, বিষয়টির উপলব্ধিবোধ শির যোগদানকে নিরুৎসাহ দিয়ে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক
সময়ে ব্রিকসে নতুন ছয়টি দেশের অন্তর্ভুক্তীকরণে চীনের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটলেও জি-২০-এ
সে রকমভাবে নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন সম্ভব নয়। সর্বোপরি জি-২০-এর নেতৃত্বের জায়গায়
তাদের নিজেদের খুঁজে পাওয়ার মতো কোনো সুযোগ দেখছেন না প্রেসিডেন্ট শি।
সম্মেলনে
জি-২০ সদস্যদের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলের আরও ৯টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ভারতের
পক্ষ থেকে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে আমন্ত্রিত হয়েছে বাংলাদেশ। এই সম্মেলন বাংলাদেশের
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, সম্ভবত আগামী
জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ বিদেশ সফর। ভোটের আগে জি-২০ সম্মেলনে ফের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সাইডলাইনে বৈঠকও করবেন
তারা। এই বৈঠকে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির ভাগাভাগি নিয়ে
আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে
এই আমন্ত্রণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এই মর্মে যে, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের
গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবর্গের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নিজের উন্নয়নের গল্প
জানানোর এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের যোগদানের মধ্য দিয়ে ভারত এবং
বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার
স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের গুরুত্বকে উপস্থাপন করা, জোটের ভবিষ্যতের
অভিন্ন স্বার্থে বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকটি উন্মোচন করার বিষয়টিও এখানে উঠে আসে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর কিছু দাবি আমলে নিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করেনি। এবারের জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা, নরেন্দ্র মোদিসহ কিছু বিশ্বনেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রভাবশালী দেশগুলোকে একটা ইতিবাচক বার্তা উপস্থাপনের সুযোগ করে দেবে নিঃসন্দেহে। সেই সঙ্গে সম্মেলনের আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সম্মেলনের পরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর এই বার্তাই দেয় যে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। মনে রাখা দরকার, বিশ্ব রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে, এশিয়ায় চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে যদি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগোতে হয়, তাহলে এই অঞ্চলে এই মুহূর্তে একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের সরকারপ্রধানের এই বার্তাও যাবে, বৈশ্বিক উন্নয়নে আমরাও অংশীজন হতে পারি এবং আমাদের সেই সক্ষমতাটুকু রয়েছে।