সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৫৩ পিএম
অলঙ্করন : প্রবা
মধ্যপ্রাচ্য তথা সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে বহুবার উঠে এসেছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেয়ে বেশি উপার্জন ও নিশ্চিত সচ্ছল জীবনের আকাঙ্ক্ষা নারী কর্মীদের অভিবাসনের মূল কারণ। কিন্তু আমরা দেখছি, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না, উপরন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়, এ তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। আমরা ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কারও কারও জীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রবাসে নারী কর্মীর অনেকেই শিকার হন যৌন নির্যাতনের। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অনেক নারী কর্মী রয়েছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, সেখানে তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ নন। এই চিত্রই আবার উঠে এসেছে ৪ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ‘দুবাই গিয়ে স্বপ্ন ভাঙছে নারী কর্মীদের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। শারজাহসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমাদের নারী কর্মী অনেকেরই নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা প্রকট, এরই চিত্র উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও এই নিরাপত্তাহীনতার ছায়া অনেক বিস্তৃত।
এ বিষয়ে দুবাইয়ের
বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল্ট জেনারেল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদকের কাছে যে
বক্তব্য দিয়েছেন তা বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘নারী
কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ খুব বেশি আসে না। কারণ নারীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত
অত্যন্ত নিরাপদ। তবে অভিযোগ এলে ভুক্তভোগী নারীদের উদ্ধার করে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা
করা হয়। তা ছাড়া স্থানীয় আইনে মামলা হলে সেখানেও সহায়তা করে থাকে মিশন।’ আমরা তার এ
বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন রাখতে চাইÑ সংযুক্ত আরব আমিরাতে নারীনিগ্রহ ও প্রতারণার
যে চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে তা কি কল্পনাপ্রসূত? সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভুক্তভোগী
নারী কর্মীদের জন্য ‘সেফ হোমের’ ব্যবস্থা নেই। যেখানে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহের
ক্ষেত্রে প্রবাসী নারী কর্মীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন, সেখানে ভুক্তভোগীদের জন্য সেফ
হোমের প্রয়োজনীয়তা কর্তৃপক্ষ দেখছেন না, এমন বক্তব্য নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। জনশক্তি রপ্তানির
সমঝোতা স্মারক বা চুক্তির ক্ষেত্রে নারী বিষয়ক সমস্যাগুলো মাথায় রেখে চুক্তির ধারা
নির্ধারণ করা উচিতÑ এ তাগিদ বিভিন্ন মহল থেকে এর আগে বহুবার উত্থাপিত হয়েছে। আমরা দেখছি,
আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যে অশিক্ষিত ও অদক্ষ নারী কর্মীরা ভাগ্যান্বেষণে গিয়ে বিড়ম্বনা
পোহাচ্ছেন বেশি। তারা সেখানে গিয়ে নিজেদের করণীয়, নিরাপত্তাসহ অন্য বিষয়গুলো বুঝতে
পারছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে সেফ হোম কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
আমাদের অভিজ্ঞতায় এও আছে, বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো রিক্রুটিং
এজেন্সি কর্তৃপক্ষও প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। আবার ভিসা সংগ্রহেও দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই
তা হয়ে থাকে সেখানে থাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে। যারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা
না করে ভিসা সংগ্রহ করছেন, তাদের দায়িত্বশীলতা নিয়েও সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে। ইতঃপূর্বে
‘কেমন আছেন অভিবাসী নারী কর্মীরা’ শীর্ষক গণশুনানিতে ভুক্তভোগী নারীরা যে অভিজ্ঞতা
বর্ণনা করেছেন তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। দেখা গেছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই
নির্যাতনের ধরন অভিন্ন। সংবাদমাধ্যম ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে প্রবাসী
নারী কর্মীদের নির্যাতন ও প্রতারণার ঘটনাবলি বহুবার উঠে এসেছে। আরব আমিরাতের ঘটনাগুলো
এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
প্রবাসী নারী
কর্মীদের সর্বপ্রথম পরিচয় তারা বাংলাদেশের নাগরিক। এ প্রেক্ষাপটে তাদের নিরাপত্তার
দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। যেসব চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অসৎ উদ্দেশ্য থাকে,
তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা মনে করি, এ
ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোর নিয়মিত নজরদারি বাড়াতে লোকবলসহ প্রয়োজনীয়
সবকিছু নিশ্চিত করা উচিত। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোয় বাধা নয়, বরং নিগ্রহ বন্ধে কূটনৈতিক
তৎপরতার ব্যাপারেও আমরা গুরুত্ব দিই। বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রবাসে নারী কর্মী পাঠানোর
ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও
সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে প্রবাসে নিয়োগকর্তার দ্বারা নিগ্রহ কিংবা অন্য যেকোনো
পন্থায় অনৈতিক আচরণের শিকার হওয়ার পর সে দেশের আইনে সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার
আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোর আরও তৎপর হওয়া
উচিত বলেও আমরা মনে করি। জরুরি প্রয়োজনে হটলাইনে যোগাযোগের সুযোগ নিশ্চিত করা হলে নির্যাতনের
শিকার প্রবাসী কর্মীদের বিড়ম্বনা অনেকটাই লাঘব হবে। প্রবাসী নারী কর্মীদের মর্যাদার
সঙ্গে দেশের মানমর্যাদা, সামাজিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার যোগসূত্রের বিষয়টিও গুরুত্বের
সঙ্গে আমলে রাখতে হবে। প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশি কর্মীরা, এমন
দুঃখজনক নজির থাকার পরও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসহায় শিকার তারা
কেন হবেনÑ এ প্রশ্নও আমরা রাখি।