× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ

আসল ব্যাপারটা ক্ষমতার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:২২ পিএম

আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৩২ পিএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একটি দৈনিকে ১৫ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম জানাচ্ছে : মশার পেছনে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে; তবে ফল শূন্য। ফল পাচ্ছি না। ওষুধেই নাকি ভেজাল আছে। একটি দৈনিক তো মস্ত সংবাদ শিরোনাম দিয়েছে দেখলাম এ রকমের : ‘মশার ওষুধে বড় জালিয়াতি’। ভেতরের খবর এ রকমের যে, উত্তর ঢাকার মেয়র মহোদয় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন বিটিআই নামের একটি ব্যাকটেরিয়া সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয়েছে এবং সেটা প্রয়োগ করাও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি ওই ওষুধ আদৌ সরবরাহ করেনি। মশাকে তাহলে পায় কে? ওই একই দৈনিক দুই দিন আগে (১৩ আগস্ট) মশা মারা বিষয়ে আরেকটি খবর দিয়েছে। সেটা এই মর্মে যে, মশা মারার প্রকল্পে ‘লুটপাটের আয়োজন’ চলছে। প্রকল্পের জন্য যেসব খরচ ধরা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বিদেশি গাড়ির জন্য ৭ কোটি, ৬০ জনের বিদেশ সফরের জন্য ২০ কোটি। আরও আছে। পরামর্শদাতার জন্য ধরা হয়েছে ৬৯ কোটি এবং দেশি প্রশিক্ষণের জন্য ১০০ কোটি।

মশারা মনে হয় বধির ও নির্বোধ, নইলে এসব গর্জন শুনে তাদের দেশছাড়া হওয়ার কথা ছিল। তারা পালায়নি। বরং আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। খবরে প্রকাশ, আমাদের অর্থমন্ত্রী নাকি এক গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে জরুরি একটা কথা বলতেই ভুলে গেছিলেন মশার কামড়ের ভয়ে! সিঙ্গাপুর থেকে ওষুধ আমদানির বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য হলো, ওষুধ আসলে এসেছে চীন থেকে। আশা ছিল ওই ওষুধে মশারা কাবু হবে। অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় এর পরপরই বলা হয়, ‘মশা নিধনে উল্টো পথে হাঁটছে কর্তৃপক্ষ’। সেই হাঁটাহাঁটির অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতে শুরু করবে। আশা করা কতটা সঙ্গত জানি না, কিন্তু আমরা ছোটখাটো মানুষ, আশা ছাড়া আমাদের ভরসা কী।

মশার সঙ্গে মশারি আসে। মশারির চাহিদা বাড়ে, দামও নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পায়। অনেককাল আগে, সেই যখন পাকিস্তান হয়েছে মাত্র তখন, একজন কবি সমাজে মানুষের সংকীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতা বোঝানোর জন্য লিখেছিলেন, ‘বড় ছোট হয়ে গেছি আমরা, মশারির ভেতরে আছি সবাই।’ পঙ্‌ক্তিটি তখন বেশ প্রাসঙ্গিক ছিল; কেননা ঢাকা শহরে তখন দুঃসহ অত্যাচার চলছিল মশার। এরপর কত যুগ চলে গেছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জয়ী হয়েছি যুদ্ধে, কিন্তু কই মশার হাত থেকে তো বাঁচতে পারলাম না। বরং উৎপাত আরও উন্নত হলো। তবে অন্যান্য উন্নতির দরুন মশারির উপমা এখন কোনোরকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে না; বিশেষ করে এই কারণে, অধিকাংশ মানুষই এখন মশারির চাইতেও ছোট জায়গায়, বলা যায় গুহায় বসবাস শুরু করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কঠোর হুকুমনামা তো ছিল এই যে, বাঁচতে হলে গুহাবাসী হওয়া চাই। ওই হুকুম মানতে যাদের গাফিলতি, তাদের অনেকেই শাস্তি পেয়েছেন প্রাণহারানোর। নিরাপত্তা দেখছি কোথাও নেই। আমরা জানতাম এবং বলতামও, ট্রেনে যাতায়াত অধিকতর নিরাপদ, এখন দেখা যাচ্ছে সেই নিরাপত্তাটা আর নেই। বড় দুর্ঘটনার কথা বাদই রাখলাম, ছিনতাইকারী ও ডাকাতচক্র পথে পথে ঢিল ছুড়ে ট্রেন থামিয়ে দেয়, তারপর ট্রেনে উঠে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে নেয়। বাধা দিলে ছুড়ে ফেলে দেয় নিচে।

এ লেখাটা লিখতে লিখতেই খবর দেখলাম : ‘বিছানায় পড়ে ছিল স্ত্রীর লাশ, ঝুলে ছিল স্বামী’। খবরটি ময়মনসিংহ শহরের। পুলিশের ধারণা, স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। নয় মাস আগে তাদের বিয়ে হয়। দুজনেরই এটি দ্বিতীয় বিয়ে।রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের ঘটনাটা অবশ্য একটু ভিন্ন ধরনের। সেখানে দুজন নয়, একজনই প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন স্ত্রী, পলাতক রয়েছেন স্বামী। স্বামী নাকি প্রেমের মাধ্যমে স্ত্রীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিলেন। তাদের দুই বছর বয়সি একটি সন্তান রয়েছে। একই দিনের ঘটনা এসব। ঘটনা আরও আছে, কেরানীগঞ্জে একটি কেমিক্যাল কারখানার গুদামে আগুন লাগায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে একই পরিবারের পাঁচজন। গুদামের পাশের বসতবাড়িতে তারা থাকতেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। তারা ঘুমিয়ে ছিলেন একটি সুন্দর সকালের স্বপ্ন নিয়েই।   

ওই একই দিনের আরও কয়েকটি খবর এ রকমের : ‘ভগ্নিপতিকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রী খুন’ (ফরিদপুরে), ‘কক্সবাজারে পাহাড়ধসে বৃদ্ধের মৃত্যু’, ‘বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের বিক্ষোভ সংঘর্ষ, একজন নিহত; পুলিশসহ আহত ২৮’, ‘পাঁচ জেলায় পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর শঙ্কা’, ‘ব্যবসায়মুখী রাজউক, মূল কাজে নজর কম’, ‘ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনের মৃত্যু, ভর্তি ১৯৩৪’, ‘বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার চলছেই’, ‘কুড়িগ্রামে প্লাবিত শতাধিক চর, ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি’, ‘খুলনায় ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সংঘর্ষ, আহত ২০; ব্যবসায়ীদের কর্মবিরতিতে ভোগান্তির শিকার চিকিৎসাপ্রত্যাশীরা’, ‘চাঁদা না দেওয়ায় শিক্ষককে মারলেন চেয়ারম্যানপুত্র’ (বরগুনায়), ‘চাল না দিয়ে মার দিলেন চেয়ারম্যান’ (সাতক্ষীরায়), ‘ঢাকায় র‌্যাব পরিচয়ে তিনজনকে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়’, ‘জনস্বাস্থ্যের স্যালাইন ইউনিট বন্ধে সংকট তীব্র’, ‘চট্টগ্রামে বন্যা-জলাবদ্ধতায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি’, ‘ডুবছে টাঙ্গুয়ার হাওর, বড় ইঞ্জিন নৌকা ও হাউসবোটের অবাধ চলাচলে এবং পর্যটকদের কর্মকাণ্ডে ঝুঁকির মুখে হাওরের জীববৈচিত্র্য’।

আসল ব্যাপারটা কিন্তু ক্ষমতার। যার ক্ষমতা আছে সে-ই বড়। মশার মতো ক্ষুদ্র হলেও। আর ক্ষমতার একেবারে জন্মগত স্বভাবটি হলো নিজেকে প্রদর্শন করা। প্রদর্শন এক প্রকারের অনুশীলনও বটে। এ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আরও ক্ষমতাবান হয়; ক্ষমতাবান হয়ে আতঙ্কের কারণ হয়, দুর্বলের জন্য। বিদ্যা সম্পর্কে বলা আছে, যতই করিবে দান ততই যাবে বেড়ে। ক্ষমতা সম্পর্কে ঠিক উল্টোটাই সত্য। ক্ষমতার নির্লজ্জতম প্রকাশের একটি হচ্ছে ধর্ষণ।

আমাদের এক অধ্যাপক-লেখক বন্ধু প্রায়ই বলতেন, কোনো কোনো বাঙালির প্রধান বিনোদন হচ্ছে ধর্ষণ। কিছুটা স্পষ্টভাষী ছিলেন। লোকে বলত দুর্মুখ। বাঙালিকে ভালোবাসতেন বলেই অধিক দুঃখের সঙ্গে বলতেন এমন কথা। এবং বলাই বাহুল্য, আমরা কেউই তাঁর কথায় সায় দিতাম না। আজ তিনি নেই, এক যুগ হবে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু আজ যদি তিনি আমাদের মধ্যে থাকতেন তাহলে তাঁর মতের বিরোধিতায় আগের মতো জোর যে পেতাম না তা সত্য। আমাদের যত প্রকারের গৌরব, অর্জন, বড়াই সবই ম্লান হয়ে যায় কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিও। কিন্তু সর্বাধিক লজ্জাজনক হচ্ছে ধর্ষণ, যা বেড়েই চলেছে। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা।

একটি ঘটনা তো গল্পের মতো শোনাবে, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সংক্রমণের চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যান ২৮ বছর বয়সি এক নারী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেশ কিছুদিন তার ড্রেসিং (ক্ষতস্থান পরিষ্কার) করেন হাসপাতালের কর্মী রিয়াজ উদ্দিন। একদিন তিনি বলেন, ‘তোমার কিছু গোপন ছবি আছে আমার ফোনে।’ ছবিগুলো দেখিয়ে তিনি হুমকি দেন, তার সঙ্গে একান্তে সময় না কাটালে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ওই নারী সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তাকে ‘ভাই’ ডেকে অনেক কাকুতিমিনতি করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ফাঁদে পড়ে সামাজিক বদনামের ভয়ে ওই অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন। সেসব মুহূর্তের ছবিও কৌশলে তুলে রাখেন রিয়াজ।

বারবার তার ওপর চলে যৌননিপীড়ন। একপর্যায়ে তিনি পুলিশের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন রিয়াজ বিদেশে চলে যান। তবে পরে তিনি ওই নারীর স্বামীর কাছে ছবিগুলো পাঠিয়ে দেন। এতে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন ভুক্তভোগী নারী। কিছুদিন পর ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ওই নারীর জীবন চরম দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তিনি ভুয়া আইডি বন্ধ ও ছবি অপসারণের জন্য আদালতে মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, রিয়াজ নন, ছবিগুলো ছড়িয়েছেন ভুক্তভোগীর জায়ের (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী) ভাই। শেষ পর্যন্ত অপরাধী শনাক্ত হলেও ওই নারীর জীবনে ওঠা ঝড় আর থামছে না। লোকজনের নির্দয় কটূক্তির কারণে তিনি এখন ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ঘরে মারধর আর গালাগাল তার নিত্যসঙ্গী। সর্বত্রই তো দেখছি ক্ষমতার দাপট!

  • শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা