× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জনপ্রশাসন

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রত্যয়

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:০৩ এএম

 ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

কিছুদিন আগে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, জনপ্রশাসনে মন্ত্রী-সচিবদের পিএস থেকে কয়েকজনকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দেখা দেয়। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব অর্পণ ভালো কিছু নয়। বিসিএসের একটি ফিটলিস্ট করা হয়। সে অনুসারে কারও যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে মন্ত্রী-সচিবের ব্যক্তিগত সহকারীও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেতে পারেন। জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের অন্যতম শক্তিশালী ইউনিট। আর জেলা প্রশাসন অত্যন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর। ইংরেজিতে ডেপুটি কমিশনার বলা হলেও বাংলায় পদটিকে জেলা প্রশাসক বলা হয়। অন্যদিকে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারকে কখনও জেলা প্রশাসক বলা হয় না। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয় কিন্তু প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় না। অর্থাৎ এখনও জেলা প্রশাসক পদটির উল্লেখে কলোনিয়াল সময়ের আইসিএস অফিসারের কথা মানসপটে প্রভাব রাখে। এ পদটির গুরুত্বও তুলনামূলক বেশি। তাই এ পদে মেধাতালিকা অনুসারে যোগ্য প্রার্থী থাকলে তাকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। তিনি যেন সুষ্ঠুভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন তার উপযুক্ত পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার প্রশাসককে ইতোমধ্যে তিন-চার মাসের ব্যবধানে স্থানান্তরের বিষয়টি নিয়ে এ স্তম্ভেই আলোচনা করেছি। তখন বলেছিলাম, স্বল্প সময়ে জেলা প্রশাসকদের এভাবে স্থানান্তরের ফলে জনপ্রশাসনে গতিসঞ্চার হয় না বরং বিঘ্নিত হয়। তবে জেলা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ থাকলে স্থানান্তর করা যেতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা দেখিনি স্থানান্তরিত জেলা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হয়েছে। তাই অল্প সময়ে জেলা প্রশাসকদের স্থানান্তর করা হলে জেলা প্রশাসনের কাজ গতিশীল না হওয়ার শঙ্কাই বেশি কাজ করে।

নির্বাচনে আগাম সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে সরকার তার অনুগামীদের জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করছেÑএমন অভিযোগ প্রায়ই উত্থাপিত হয়। নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছক কষার জন্য জনপ্রশাসন ব্যবহারের এ অভিযোগ নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। কারণ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবং যদি সত্যই রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা আদায়ের অপপ্রক্রিয়া জনপ্রশাসনে চলমান থাকে তাহলে জনপ্রশাসনের স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়। যদিও বলা হয়, রাজনীতি ও প্রশাসন ভিন্ন সত্তা। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতা বলে, প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এ বিষয়টিকে অবশ্য অন্যায় বলা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্পয়েল সিস্টেম ও মেরিট সিস্টেম এ দুটি প্রক্রিয়াই দেখা যায়। স্পয়েল সিস্টেমের বিষয়টি রিপাবলিক কিংবা ডেমোক্র্যাট উভয় দলই ঘোষণা দিয়ে রাখে। ক্ষমতাসীন দল থেকে কতজন ব্যক্তি জনপ্রশাসনে নিয়োগ পাবে সে কথা তারা নির্বাচনের আগেই উল্লেখ করে থাকে। অতীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও কাউকে কাউকে জনপ্রশাসনে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ দলের সমমনা কাউকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয় প্রাধান্য পায়। তবে নির্বাচনের আগে এমন নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বভাবতই অভিযোগ আসা স্বাভাবিক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রসঙ্গ এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আস্থার সংকটের প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে চলে আসে। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো প্রশাসনিক মহলেও বিরোধ তৈরি করলে জনসেবার পথ অমসৃণ হওয়ার আশঙ্কা যে অনেকের করেন তা অসঙ্গত নয়। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার ২২টির প্রশাসক রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা কোনো মন্ত্রী বা সচিবের পিএস কিংবা এপিএসের দায়িত্ব পালন করতেন। সম্প্রতি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ৩০ জেলা প্রশাসকের মধ্যে পাঁচ-ছয় জন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। জেলা প্রশাসকরা জনসম্পৃক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করেন। আর জনসম্পৃক্ত থাকেন বলেই নির্বাচনের সময় তাদের নিয়োগকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা থেকে যায়। যদিও অধিকাংশ জেলা প্রশাসকই মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তবু কিছুটা সংশয় সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। গত দুদিন আগে জামালপুরের জেলা প্রশাসক ক্ষমতাসীন দলের ভোট চাওয়ার তাকে শোকজ করা হয়।

প্রশাসনে পিরামিড আকৃতির কথা বলা হয়। সম্প্রতি পদের তুলনায় প্রমোশনের মাত্রাই বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনে নিম্ন শ্রেণি অপেক্ষা মধ্য শ্রেণিতে পদের তুলনায় জনবল অনেক বেশি। জনবলের এ বৈষম্যের ফলে পিরামিড আকৃতি অনেকটা ভেঙে পড়ছে। ম্যাক্স ওয়েবার যখন আমলাতন্ত্রের ধারণা দিয়েছিলেন, তখন স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন, নিচ থেকে ওপরের দিকে জনবল কম হবে। কারণ পিরামিডের ওপরাংশের জনবল সরাসরি তত্ত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত থাকেন। তবে পর্যাপ্ত প্রমোশন না থাকলেও জনপ্রশাসনের গতি বিঘ্নিত হতে পারে। বর্তমানে আমরা ২৬টি ক্যাডার দেখতে পাই। অতীতে ক্যাডার সংখ্যা ৩০ ছিল। পরে ক্যাডার সংখ্যা ২৮ করা হলো। ইউনিফায়েড গ্রেডিং স্ট্রাকচার রিপোর্ট ১৯৭২ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে প্রস্তুত করা হয়। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তী মাসে আরেকটি রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়। এ রিপোর্ট অনুসারে শ্রেণিহীন জনপ্রশাসন গড়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও বলেছিলেন, পিরামিড আকৃতি থাকলেও সেখানে শ্রেণি থাকবে না। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ে যিনি কাজ করবেন তিনি সব ক্যাডারের সমান সুযোগসুবিধা পাবেন। ওই সময় জনপ্রশাসন কর্মীরা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন এমন একটি ধারণাই বহুলপ্রচারিত ছিল। জনপ্রশাসনের প্রত্যেকেই জনগণের জন্য কাজ করবেন। পদোন্নতির সুযোগ না থাকলে জনপ্রশাসনে শ্রেণি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং জনপ্রশাসনের গতি শ্লথ হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। নির্বাচনের সময় মেধাতালিকার ভিত্তিতেও যদি নিয়োগ দেওয়া হয়, তার পরও রাজনীতিসম্পৃক্ততার কারণে অনেক সময় জনপ্রশাসন কর্মকর্তাকে ঘিরে জনমনে আশঙ্কা থাকতে পারে।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রত্যয় থাকুক অগ্রভাগে। এ প্রত্যয় বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রশক্তিকে মনোযোগ দিতে হবে সেভাবেই। আমাদের স্মরণে আছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জনপ্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত রাখা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি এ চেষ্টা তার মেয়াদকালে অব্যাহতও রেখেছিলেন। আমরা জানি, সরকার যেসব জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি নেয়, সেগুলো জনপ্রশাসনের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। সেখানে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের স্থলে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে জনকল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন যে হয়নি তাও কিন্তু নয়। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে নির্মোহ থাকতে হবে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে।

দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য মেধাতালিকাকে প্রাধান্য দিতে হবে। মেধাতালিকার পাশাপাশি সিনিয়রিটিও বিবেচ্য বিষয়। মেধা ও সিনিয়রিটির সমন্বয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া করা জরুরি। জনপ্রশাসনে যিনি দায়িত্ব পাবেন তিনি রাজনীতিসচেতন হবেন কিন্তু রাজনীতিপরায়ণ হবেন না। রাজনীতিপরায়ণতা রোধ করা গেলে জনপ্রশাসন আরও গতিশীল হবে। রাষ্ট্রের জনগণকে উপযুক্ত সেবা প্রদানই হবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। একজন ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেই পারেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে জনপ্রশাসনে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নতির স্বার্থে তিনি তার মেধা নিয়োগ করতে পারেন এবং জনগণকে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পৌঁছে দিতে পারেন। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাজনীতি ও প্রশাসন সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও জনসেবা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব পালন কর। সরকারের উচিত জনপ্রশাসনে যৌক্তিক নিয়োগ পদ্ধতি চালু করা জরুরি। প্রাধান্য দিতে হবে যেন অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে দক্ষতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় জনপ্রশাসন এই লক্ষ্যকে। জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে জনপ্রশাসনে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফলপ্রসূ স্বচ্ছতা পাওয়া গেছে। আমাদের দেশে এ নিয়ে আইন হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। পদ খালি থাকলেই তা পূর্ণ করার যৌক্তিকতা নেই। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার যেন উচ্চারণেই বৃত্তবন্দি না থাকে।

  • অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা