রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
ডেভিড মিলিব্যান্ড
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২৪ পিএম
সম্প্রতি ন্যাটোপ্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ সতর্ক করেছেন যেÑ ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি
হবে না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিয়েভের অব্যাহত পাল্টা আক্রমণের মধ্যে তার এই মন্তব্য যুদ্ধের
বিদ্যমান বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে। এরও আগে ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক
মাইকেল কোফম্যান পশ্চিমা দেশগুলোকে ‘দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি’ নেওয়ার তাগাদা দিয়েছিলেন।
তিনি মূলত সামরিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন। গোলাবারুদ, আকাশপথের
আক্রমণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যোদ্ধাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের
প্রসঙ্গটি তুলে আনেন। কোফম্যান ভুল কিছু বলেননি। সম্প্রতি আমি নিজে কিয়েভ ভ্রমণে গিয়েছি
এবং ইউক্রেনিয়ানদের বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ইউক্রেনের জনগণও ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
যেহেতু শিগগিরই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না, তাই সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান
হবে না। জনগণের সুরক্ষা এবং মানব সংবেদনশীল পরিকল্পনা নেওয়াও জরুরি।
দুঃখজনক হলেও
সত্য, যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে ততই প্রতিবন্ধকতা বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিবন্ধকতার পরিসংখ্যানটিও
ভয়াবহ। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হচ্ছে ততই মানবিক সহায়তার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। যারা সহায়তা
দেবেন, তারাও জীবনের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। চলতি বছরের
জুনে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইউক্রেন রিকভারি কনফারেন্সে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ
আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে এই সহায়তা ইউক্রেনের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের
জন্য দেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের বিষয়ে অগ্রগতি কি থাকবে।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াটিই ভয়াবহ। ইউক্রেনের জনগণের ওপর
ভয়াবহ মানসিক চাপ বয়ে যাচ্ছে। প্রিয়জনের মৃত্যু, প্রিয়জনকে হারানোর ভয়, শিক্ষা ও অন্যান্য
অধিকারবঞ্চিত হওয়া, রাতে আকাশপথে আক্রমণের ভয়ে ঘুম না হওয়া, এমনকি উদ্বাস্তুর মতো প্রাণ
বাঁচাতে ছুটে বেড়ানো পরিস্থিতিই তাদের কাছে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত এটিকেই
অস্বাভাবিক পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণ বলতে চাচ্ছি।
বীরত্ব আর একরোখা
ভাব সংকট পুরোপুরি ঢাকতে পারে না। বর্তমানে ১৮ মিলিয়ন ইউক্রেনবাসীর মানবিক চাহিদা অপূর্ণ
রয়েছে। বিশেষত যুদ্ধবর্তী অঞ্চল এবং সাময়িক রাশিয়ান নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে প্রায়
৬ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে। তাদের উদ্বাস্তুর মতো মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল
রেস্কিউ কমিটির কোনো দল যখনই এসব অঞ্চলে উদ্ধারকার্য চালায়, তখন তাদের আর্তির খবরও
গুরুত্বের সঙ্গে সহায়তাকারীদের কাছে পাঠানোর চেষ্টা করে। ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি
প্রায়ই মানুষের ট্রমাজনিত নানা ঘটনার সাক্ষাৎ পায়। শুধু তাই নয়, বৃদ্ধরা এমনিতেও চলাচল
করতে পারেন না। তারা যুদ্ধের সময় পালাতেও পারেন না। বৃদ্ধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের
সহায়তার দরকার বেশি। সামনে আসছে শীত। এই শীতের সময় শীতলীকরণের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার
বিষয়টিকেও কি এড়ানো সম্ভব? গত বছর ইউক্রেনে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে এসেছিল। এ
সময় পানি ও শক্তি উৎপাদক কেন্দ্রগুলোতে রাশিয়ানরা আক্রমণ করে। সামরিক এই কায়দা পুরোপুরি
যুদ্ধের প্রথাবিরোধী। শুধু তাই নয়, নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা সম্প্রতি বাড়তে
শুরু করেছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের
পরিকল্পনা নেওয়া মানে শুধু সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোই নয়, শারীরিক সক্ষমতার সমান্তরালে
মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিতে হবে। যুদ্ধকালীন শিশু ও বৃদ্ধদের মতো
নমনীয়দের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। তার মানে প্রমাণনির্ভর এবং সাশ্রয়ী
মানব সংবেদনশীল কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। যুদ্ধের নেতিবাচক
প্রভাবের শিকার মানুষদের সহায়তা পৌঁছে দিতে আর্থিক প্রণোদনা জোগাড়ের দিকে মনোযোগ গভীর
করা জরুরি। বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে অর্থের জোগান বজায় রাখতে হবে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে।
ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে অবশ্য ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অগ্রণী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে অনেকে।
একাধিক এনজিও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। তা ছাড়া কিছু মোবাইল হেলথ টিম যুদ্ধাক্রান্ত
এলাকায় দ্রুত সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিদ্যমান সংকটে
সিভিল সোসাইটি থেকে অনেককে এগিয়ে আসতে হবে। মানব সংবেদনশীল প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের
সিভিল সোসাইটি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। ২০২২ সালে ইউক্রেন মানব সংবেদনশীল চাহিদার
বিষয়টি স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছিল। ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির পথ বন্ধ করে দেওয়ায়
দেশটির অর্থনীতি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। শুধু ইউক্রেন নয়, সারা বিশ্বে খাদ্যশস্যের
দাম আকাশচুম্বী। জাতিসংঘ ৯টি দেশকে খাদ্যসংকট বা মহামারিভুক্ত করেছে। পূর্ব আফ্রিকার
৫০ মিলিয়ন মানুষ না খেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে। তাদেরও সাহায্য প্রয়োজন। মানবিক সমস্যা সামনে
আরও গাঢ় হবে, যদি আমরা এখনোই পদক্ষেপ না নিই। এখন নেতাকর্মীদের সক্রিয় হতে হবে। তাদের
বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালু
করতে হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। ইউক্রেন যদি
সমগ্র বিশ্বের সংকটের প্রতিভূ হয়ে থাকে, তাহলে দেশটিকে অনেকগুলো যুদ্ধ লড়তে হবে। এই
দীর্ঘ যুদ্ধ তাদের জন্য নানামুখী সংকটই ডেকে আনছে।
দি গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন