পরিপ্রেক্ষিত
আরকে চৌধুরী
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৪৭ এএম
কিশোর কুমার গেয়েছিলেন,
‘জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের দাম কমেছে, হায়রে কপাল করব কী’। কিশোর কুমারের এই গানে
নিম্নমধ্যবিত্তের যে অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটেছিল তা এক কঠিন বাস্তবতা। জিনিসের দাম বাড়লে
মানুষের দাম কমে, এটি সংসারের ঘানি টানা নিম্নবিত্তের প্রতিক্ষণের উপলব্ধি। বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া ভোক্তা মূল্যসূচকের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, চলতি
বছরের আগস্টে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ; যা এর আগে কখনও হয়নি।
এর আগের মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি
বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ১১ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির এ হার সর্বোচ্চ। ২০২০-২১ অর্থবছরে
খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে
খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণের ঢের বেশি। বিবিএসের হালনাগাদ তথ্যে
বলা হয়েছে, আগস্টে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ,
মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে
অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। গত ১৫ বছরে ক্ষুধাজয়ের ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য
দেখিয়েছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে
মূল্যস্ফীতির যে ভয়াল দৈত্য মানুষের ওপর চেপে বসেছে, তাতে ক্ষুধার জ্বালা না বাড়লেও
জীবনমান কমেছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অন্যান্য খাতের চাহিদা অপূরণ
থাকছে। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়েও কৃচ্ছ্রতা চলছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে গত অর্থবছর
বাংলাদেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। অবশ্য ওই সময় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়লেও
ভারত, নেপালসহ নানা দেশে মূল্যস্ফীতি কম ছিল বলে জানায় বিশ্বব্যাংক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান
হিসেবে বিবিএস সরকারি তথ্য-উপাত্তকেই গুরুত্ব দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতি আরও
বেশি হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ বড়ই বিপাকে। তাই বিতর্কে না গিয়ে কীভাবে
মূল্যস্ফীতি কমানো যায়, সেদিকেই মনোযোগ দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি সুষ্ঠুভাবে
করা গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে। দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো নিত্যপণ্যের দাম
বাড়লে সেটি যত দ্রুত কমিয়ে আনার ওপর জোর দিতে হবে। দীর্ঘসূত্রতা বড় সংকটের সৃষ্টি করতে
পারে। দাম বেশি হলেও তা নিয়ন্ত্রণে আছেÑ এমন বক্তব্যে অসাধু ব্যবসায়ীরাই প্রশ্রয় পায়।
অনেকটা এ কারণেই বিশ্ববাজারের প্রভাবে আমাদের দেশে পণ্যের দাম যতটা বাড়ে, তার চেয়ে
বেশি বাড়ে স্থানীয় বাজারের কারণে।
সাধারণ মানুষ
বিশেষ করে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি ঠেকাতে মূল্যস্ফীতি
কমানোর উদ্যোগ নিতেই হবে। পণ্যের আমদানি-রপ্তানি সরবরাহ ও মজুদ তথ্যে যেন গরমিল না
থাকে তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির
মাধ্যমে যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে
খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এগুলো যেন
যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে
কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে
বাজারে তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।