সম্পাদক
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৩২ এএম
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপট জলবায়ু পরিবর্তনজনিত
কারণে সৃষ্টÑ এ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ঋতু পরিক্রমায় আমরা শরৎকালে প্রবেশ
করেছি। শরতের শ্বেতশুভ্র মেঘ থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টির বদলে ঋতুর শুরুতেই যেভাবে প্রায়
প্রতিদিনই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছেÑ তা আমাদের বিগত দিনের জীবনযাপনের সঙ্গে
বড় বেশি অমিল দৃশ্যমান হচ্ছে। বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকায় জনভোগান্তির সীমা-পরিসীমা থাকে
না। শরতের আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘ আর জমিনে ঢেউ খেলে যাওয়া কাশফুলের যে দৃষ্টিনন্দন অনন্যশোভা
উপভোগ্য হয়, এর মধ্যে সাম্প্রতিক দৃশ্যপট আমাদের অনভ্যস্ত জীবনে অনেকটাই অবিশ্বাস্য
মনে হয়।
২১ সেপ্টেম্বর অপরাহ্ণ থেকে ক্রমান্বয়ে ভারী বৃষ্টিপাত রাজধানীবাসীর
জন্য কতটা দুর্ভোগ ও মর্মস্পর্শী ছিলÑ তা পথে থাকা অগণিত মানুষের অভিজ্ঞতায় মূর্ত হয়ে
ওঠে। ২২ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনগুলো
ফের দেখিয়ে দিয়েছে, এই মহানগরের মানুষ কতটা অসহায়। সাধারণত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপকূলবাসীর
জীবনঝুঁকির অনেক অধ্যায় আমাদের সামনে মর্মন্তুদ স্থিরচিত্র হয়ে আছে। কিন্তু ২১ সেপ্টেম্বর
রাজধানীর বৃহদাংশের চিত্র ফের সাক্ষ্য দিয়েছে, এ যেন মহানগর নয়Ñ থই থই জলরাশির বিস্তীর্ণ
এলাকা। ঘর থেকে বের হওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঘরে ফিরতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
অনেকক্ষেত্রে রাতের শেষলগ্ন পর্যন্ত পানিবন্দি হয়ে রাস্তায় আটকে থাকতে হয়েছে। আর সারি
সারি যানবাহনের স্থবির হয়ে থাকা চিত্র দেখে মনে হয়েছে, জলমগ্ন ঢাকায় এসবই যেন শোলার
মতো ভাসমান কোনো বস্তু। জলমগ্ন সড়কে পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজনের প্রাণহানি
ঘটেছে মিরপুর কমার্স কলেজের সন্নিকটে।
সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনভোগান্তি কত প্রকট
হয়ে ওঠেÑ তার নজির আমাদের সামনে রয়েছে বিস্তর। ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রাত বিগত প্রাকৃতিক
বিপর্যয় সিত্রাংয়ে সৃষ্ট দৃশ্যপট পুনর্বার সামনে নিয়ে আসে। তবে চলতি বছরের মধ্যে ২১
সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিপাতে রাজধানীবাসীর ভোগান্তির মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। জলযট ও যানজটে
রাজধানীবাসীর নাকাল হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে
এই দুই উপসর্গের সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনা আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে,
এই মহানগরের জীবনযাত্রার পথে পথে কত মৃত্যুফাঁদ জিইয়ে আছে। ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই রাজধানীর
বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে বিভীষিকার ক্ষেত্র কীভাবে বিস্তৃত করছিল এর খণ্ডচিত্র প্রায়
তাৎক্ষণিকভাবেই সংবাদমাধ্যমগুলোর অনলাইন সংস্করণে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে
উঠে আসছিল। আমরা জানি, বৃষ্টি যদি প্রলম্বিত হয় এবং তা যদি হয় আবার ভারী, তাহলে রাজধানীবাসীর
কপালে সংগত কারণেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ কতটা গাঢ় হয়ে পড়ে। রাজপথ ছাড়িয়ে অলিগলিতে থই থই
পানিতে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি অনেক এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানপাট ডুবে গিয়ে
ক্ষয়ক্ষতির যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা মহানগরীর বিপজ্জনক
পরিস্থিতিও পুনর্বার সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা ওয়াসা বরাবরই বৃষ্টিপাতের উচ্চ পরিমাণের
কথা বলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে পার পেতে চায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি জনবিড়ম্বনা দূর হবে না?
ভারী বৃষ্টিপাত হলে সাময়িক জলযট অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু পানি
নিষ্কাশন ব্যবস্থা যদি সুষ্ঠু থাকে, তাহলে পানি সরে যেতে সময় লাগার কথা নয়। সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীলদের তরফে যত ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, এমন চিত্র কোনোভাবেই স্বাভাবিক
নয়। রাজধানীর অনেক এলাকার মানুষ এখন যেন সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ঘর পোড়া গরুর মতো ভয় পান।
জনবহুল এ মেগাসিটিতে সড়কপথে গতি বাড়াতে ইতোমধ্যে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা
হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু অগ্রগতি কতটা হয়েছেÑ প্রশ্নটা সেখানেই। আমরা
জানি, ঢাকার ভেতর দিয়ে চলা খালগুলো দখল হয়ে গেছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাসহ সংলগ্ন
অন্য নদীগুলোর পাড়েও পড়েছে দখলের থাবা। একই সঙ্গে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে ক্রমান্বয়ে
কমছে পানির ধারণক্ষমতা। সমস্যার কারণ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের
সবার জানা। সমাধানও অজানা নয়। ঢাকা ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশন ও অন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
মহলগুলোর সমন্বয়হীনতায় এত উন্নয়নের পরও জনদুর্ভোগ নিরসন না হওয়ায় পরিকল্পনাগত ত্রুটির
বিষয়টিও সংগত কারণেই সামনে আসে।
খাল পুনরুদ্ধারের কথা বারবার বলা হচ্ছে, একই সঙ্গে বুড়িগঙ্গাসহ অন্য
নদীর তলদেশ থেকে পলিথিন, কাদামাটি ও অন্যান্য দ্রব্য অপসারণের জন্য বরাদ্দও কম হয়নি।
নদীগুলোর ড্রেজিংয়ে মহাপরিকল্পনার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে
তা তো বিদ্যমান পরিস্থিতিই সাক্ষ্য দেয়। আমরা কথা অনেক শুনেছি এখন কাজ দেখতে চাই। বৃক্ষের
পরিচয় বুঝতে চাই ফল দিয়েই। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণ যেহেতু চিহ্নিত সেহেতু এর নিরসন
দুরূহ হবে কেন? কেনইবা জিইয়ে থাকবে মৃত্যুফাঁদ?