× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জননিরাপত্তা

সন্ত্রাসীরা ফণা তুলছে, কৌশল পাল্টাতে হবে

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৫০ পিএম

সন্ত্রাসীরা ফণা তুলছে, কৌশল পাল্টাতে হবে

২১ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত ‘নির্বাচনের আগে ফিরছে দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। অতীতেও নির্বাচনের আগমুহূর্তে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের দৌরাত্ম্য বাড়তে দেখা গেছে। সংবাদমাধ্যমের মারফত আমাদের সামনে উঠে আসা এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির চিত্র জনমনে একদিকে যেমন শঙ্কা বাড়ায়, তেমনি এ বিষয়ে সমন্বয়মূলক আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগাদাও দিয়ে থাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। নির্বাচনের আগে উগ্রপন্থি, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। নির্বাচনের আগে এমন সংবাদ উদ্বেগের কারণ অবশ্যই। আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হয়। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের ব্যবহার করা হয়। জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থÑ এই তিনটি ব্যাপক উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে ঘনীভূত হতে শুরু করে এবং উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ত্রাসী কিংবা উগ্রবাদীদের ব্যবহার করা হয়।

সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ যারা করে, তাদের আমরা সচরাচর আন্ডারগ্রাউন্ড বলে আখ্যায়িত করি। আন্ডারগ্রাউন্ড শীর্ষ মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রয়োজন হলে আন্ডারগ্রাউন্ডে নির্দেশনার মাধ্যমে তারা বিচ্ছিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সংগঠিত করতে শুরু করে। জঙ্গি সংগঠনগুলো তখন তাদের সংগঠনের অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের সুযোগ পায় এবং তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তা ভয়াবহভাবে বিঘ্নিত হয়। হত্যা ও লুণ্ঠনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও তারা জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা আদায়ের দূরদর্শী একটি পরিকল্পনা প্রায় সব জঙ্গি সংগঠনের থাকে। তাই তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে দায়মুক্তির পরিবেশ যেন নিশ্চিত হয়, সেজন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো নির্বাচনের আগে তৎপর হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এই সময় দুই পক্ষের স্বার্থেরই একধরনের সমন্বয় গড়ে ওঠে।

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল এবং জঙ্গি সংগঠনের এই সমন্বয় জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে কিছু কিছু জঙ্গি সংগঠন কিভাবে দেশে অপরাধ সংঘটিত করেছে। কারণ তারা একধরনের দায়মুক্তির পরিবেশ আগে থেকেই পায়। যখন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গী সংগঠনকে দমন করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং সাফল্য মেলে তখন জননিরাপত্তা বাড়ে। মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা, নিরাপদে বসবাসের অধিকার, নিজ সম্পত্তি ভোগের অধিকারসহ নানা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের দমানোর মধ্য দিয়ে। চাঁদাবাজি, রাহাজানির ছায়া না থাকলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক উন্নতিও করতে পারে। নির্বাচনের আগে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আগমনের সংবাদমাধ্যমের বার্তা তাই আমরা স্বাভাবিক বার্তা হিসেবে দেখতে পারছি না। তবে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আগমন ঘটছে তা খুঁজে বের করা দরকার। যেমনটি বলেছি, এই সন্ত্রাসীরা কাদের আশ্বাসে বা দায়মুক্তির পরিবেশ পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছেÑ তা খুঁজে বের করা দরকার। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে নির্বাচনের আগেই তদন্ত করে সন্ত্রাসী উগ্রবাদীদের শনাক্ত করতে হবে।

আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চাই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হয় সর্বাগ্রে। কিন্তু শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যখন নির্বাচনী সময়ে সক্রিয় থাকবে, তখন নানাভাবে তারা ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। আমাদের নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্নÑ এই বিষয়টি দায়িত্বশীল প্রত্যেকটি মহলকে গুরুত্ব সহকারে মনে রাখতে হবে এবং সেভাবেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এও মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, সন্ত্রাসীদের সক্রিয়তা শুধু জননিরাপত্তাই নয়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের জন্যও প্রতিবন্ধক। কারণ যারা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ নেবেন, তাদেরও ক্ষতি করার জন্য এই জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হবে। রাজনৈতিক স্বার্থেই সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়; যেন তারা ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে এবং নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের অবস্থা শান্তিপূর্ণ রাখার স্বার্থে সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য, গতিবিধি ও যোগাযোগের বিষয়গুলো সুচারুরূপে খতিয়ে দেখা জরুরি। পরিস্থিতি কতটা জটিল আকার ধারণ করতে পারে, তা ইতোমধ্যে তেজগাঁওয়ে ঘটে যাওয়া মর্মন্তুদ ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর দণ্ডভোগের পর কারামুক্ত এক সন্ত্রাসী্র গাড়িতে আরেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলা করে (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২০ সেপ্টেম্বর)। হামলার সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হলে পথচারী এক আইনজীবীর মাথায় গুলি লাগে। আহত আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির বেসরকারি একটি হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আরেক পথচারী গুরুতর আহত হন সেদিন। সন্ত্রাসীদের নিজেদের সংঘর্ষের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনঝুঁকির নঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। যখন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়, তখন নির্দিষ্ট একটি এলাকায় নিজ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। এই আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। এই সংঘাতের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। আতঙ্ক-উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ তখন নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে কিছু পরিবর্তন আনেÑ যা তাদের স্বাধীনতার ওপর স্পষ্ট হস্তক্ষেপ। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার পেছনে স্বার্থের লড়াই, অর্থ ভাগাভাগির লড়াই এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরও সম্পর্ক রয়েছে। যদি এখন থেকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র বাস্তবায়ন না করা যায়, তাহলে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসী সংগঠনের সক্রিয়তার ফলে আরেকটি বিষয় আমাদের উদ্বেগান্বিত না করে পারে না। যখনই তারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তখন নিজেদের দল ভারী করার জন্যও কর্মসূচি পরিচালনা করে। তখন অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালানের ব্যব্সাও বেড়ে যায়। জঙ্গি গোষ্ঠীর সক্ষমতা বাড়াতে দখন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও নেওয়া হয়। আইনের শাসন এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। কোনো কোনো দেশে এসব মাফিয়া সরকারি উর্দিপরা বাহিনীর তুলনায়ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। সন্ত্রাসীদের ফের সক্রিয় হয়ে ওঠার যে উদ্বেগজনক চিত্র সংবাদমাধ্যমে দেখা যাছে, তাতে মনে হয় চসাঁড়াশি অভিযান চালানো জরুরি।

দেশের সিংহভাগ মানুষ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো কোনো রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চার করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। কিন্তু এবার তারা নিজেদের সমর্থন ও শক্তিমত্তা দেখাতে পেরেছে। প্রথম থেকেই অনেকের আশঙ্কা ছিল, এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত সহিংসতার দিকে এগিয়ে যায় কি না। এই আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা কিংবা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকায় তারা একে অপরকে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু দেশের মানুষ চায় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ। জনজীবনে ভোগান্তি তৈরি না করে যেন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়Ñ এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই কাম্য।

সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতার ফলে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা বেড়েছেএ অভিযোগও আছে। এরই পাশাপাশি সম্প্রতি বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের প্রবণতাও অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়ছে।  কোনো কোনো দলে আত্ন:সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে। প্রকৃতার্থে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কখনই ছিল না। প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র প্রদর্শন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য শুভবার্তা নয়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমেই এমনটিও দেখা গেছে। দেশের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন যথেষ্ট শক্ত। চাইলেই যে কাউকে অস্ত্রের লাইসেন্স সরকার দিতে পারে না। পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করার পর যদি দেখা যায় কারও জীবন হুমকির মুখে রয়েছে, তাহলেই অস্ত্রের লাইসেন্স তাদের দেওয়া হয়। বৈধ বা অবৈধ হোকÑ অস্ত্র তো অস্ত্রই। অনেকেই বৈধ অস্ত্রের মাধ্যমেও মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করেন। ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ প্রদর্শনও আইনের আওতায় আসার কথা। যারা এভাবে ত্রাস সৃষ্টি করবেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গোপনে অবৈধ অস্ত্রের জড়ো করার চেষ্টা করছে আন্ডারগ্রাউন্ডÑ এমনটি সহজেই অনুমান করা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাই নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। কোনো গোষ্ঠী যেন জনমনে আতঙ্ক সঞ্চার করতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে। সর্বাগ্রে জননিরাপত্তা তা মনে রাখতেই হবে।


  • নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা