সম্পাদক
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:১১ পিএম
দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিদ্যমান
বৈশ্বিক সংকটের বিরূপ ছায়াও পড়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয়
কমাতে চাহিদার কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহারে
পরিবর্তন আনল বাংলাদেশ ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভে পতন এবং ডলার সংকটের মুখে
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমরা জানি, চলতি অর্থবছরের
বাজেটে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন এর বাস্তবায়ন
তো সম্ভব হয়ইনি উপরন্তু তা বাড়ছেই। দেশের অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতিকে ইতোমধ্যে ‘নীরব
ঘাতক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এই পর্যবেক্ষণের যথার্থ যুক্তি যে রয়েছে তা অস্বীকারের
জো নেই। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য যেমন বেড়ে যায়, অন্যদিকে
প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো অপরিহার্য ব্যয়ে কাটছাঁট করতে বাধ্য
হয় সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন মূল্যস্ফীতির কারণে কতটা প্রতিকূলতায় পড়েছে
এর চিত্র একাধিকবার উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে জীবনযাত্রার মান অনিবার্যভাবেই নিম্নগামী
হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সামনে বহুমুখী প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার
চিত্রও একাধিকবার প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ উঠে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিবিদ
ও বাজার বিশ্লেষকরা বিভিন্ন সময়ের যেসব সুপারিশ করেছেন তা আমলে নেওয়ার তাগিদ এই সম্পাদকীয়
স্তম্ভে আমরা ইতঃপূর্বে দিয়েছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বাজার তদারকিসহ নিত্যপণ্যের
দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সাধ্যের মধ্যে রাখার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যতটা না
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কথা বলেছেন। মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতিসুদহার দশমিক
৭৫ শতাংশ বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে
নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য রয়েছে এর বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ যে কম নয় এ-ও আর নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের
প্রয়োজন রাখে না। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘবে সামাজিক সুরক্ষা
কর্মসূচির পরিধি ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা দিয়েছিলাম।
আমরা এ-ও বলেছিলাম, শুধু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোই
শেষ কথা নয়, প্রকৃত ভুক্তভোগীরা যাতে এর সুফল পান এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা
স্পষ্টতই মনে করি, মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করা বর্তমানের
বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের সব কর্মকৌশল দৃশ্যমান করতে কথা নয়, কাজের কাজ
করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে পণ্যের দাম সমন্বয়ের বিষয়েও কার্যকর
পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের অজানা নয়, দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ কিছুটা
বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা এ প্রশ্নও রাখি, আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম
ও পরিবহন ভাড়া কমেছে এর ইতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারে কতটা দৃশ্যমান? এক্ষেত্রে বাজার
তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর অবহেলা কিংবা অদক্ষতার কথাও
নতুন করে বলার কিছু নেই। জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সীমিত
ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী যে চাপে পড়েছে এই প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ এবং এর
বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
দেশের মূল্যস্ফীতির হার আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের সমগোত্রীয় দেশগুলোর
তুলনায় গত কয়েক বছর ধরেই উদ্বেগজনকভাবে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নীতি সুদহার
ও ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিষয়েও আমরা ইতঃপূর্বে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনী দামামা ক্রমেই বাড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ নির্বাচনী দামামার মধ্যে অর্থ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট
সব পক্ষ সেই কাজটি কতটা সফলতার সঙ্গে করতে পারে সেটিই দেখার বিষয়। বাজারে নিত্যপণ্যের
সংকট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যক্তিরা ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট স্ফীত করার সুযোগের
সন্ধানে থাকে—এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রকৃতার্থে এটিই বাস্তবতা। যদি অব্যবস্থাপনা
জিইয়ে থাকে এবং এ খাতে সর্বাগ্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করা যায় তাহলে জোগান শৃঙ্খলের
বিষয়টি নিশ্চিত করেও সংকট থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো যেহেতু
সরকারের দায়িত্বশীল মহলগুলোর অজানা নয় সেহেতু সেগুলো উতরানোর পথ স্পষ্ট করার দায়িত্বও
তাদেরই। আমরা ফের এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নীতি ঘোষণাই শেষ কথা নয়; এর সফল বাস্তবায়নই
হলো মূল কথা। আমাদের মতো অর্থনীতিতে ছাপানোট থাকার ফলে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও বেশি থাকে,
কারণ সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে বিধায়। অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে সংকট উত্তরণের পথ সন্ধান না
করতে অর্থনীতিবিদরা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা-ও আমলে রাখা জরুরি বলেই আমরা মনে করি।