সম্পাদক
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:২৯ পিএম
চালবাজি শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই শব্দটি ভোক্তার মুখে মুখে শোনা যায়। দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে গত অক্টোবরে, ১২.৫৬ শতাংশে। আমরা দেখছি বাজারে আকস্মিক কোনো না কোনো নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে আটা, জুলাইয়ে কাঁচামরিচ এবং অক্টোবরে পেঁয়াজ-আলু-ডিমের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যায়। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দেয়। একই সঙ্গে এ কথাও বলা হয়, দেশে আলুর কোনো সংকট নেই, বরং পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ আছে। সম্প্রতি কিছু ডিম ও আলু আমদানির পর দুটি নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা নিম্নগামী হলেও ফের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে চালের দামে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সংকট-শঙ্কা নেই তবুও চালের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের বক্তব্যÑ অবরোধে পরিবহন ব্যয় বাড়ায় দাম বেড়েছে। আমরা এও দেখেছি, যখনই কোনো পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে তখনই অসাধু ব্যবসায়ীদের অজুহাতেরও কোনো অভাব থাকে না।
আমরা জানি, ইতোমধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাজারে নতুন ধানের
চালও আসতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে চিকন ও
মোটা চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) একশ থেকে দুইশ টাকা বেড়ে গেছে। খুচরা বাজারে বেড়েছে
আরও বেশি। বাজার বিশ্লেষকরা তো বটেই, সরকারের দায়িত্বশীলরাও বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজির
কথা স্বীকার করেছেন। প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশ, বাণিজ্য ও কৃষিমন্ত্রী কয়েকদিন আগেও
বলেছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ যেন দায়িত্বশীলদের
অশুভ শক্তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ! আমরা এও দেখছি, যেসব পণ্য আমদানি করা হয় আন্তর্জাতিক
বাজারে সেসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দেখা যায় বিপরীত চিত্র।
কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখতে গিয়ে অনেক গবেষকই দেখেছেন, উৎপাদক থেকে
ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত দামের বিস্তর ফারাক। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পান
না, অথচ সেই পণ্যই আবার বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়Ñ এ অভিযোগও নতুন নয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা
এর পুরো ফায়দা লুটে নেয়।
চালের দাম বাড়ার পেছনে মিলারদের চালবাজির বিষয়টিও পুরোনো। ইতঃপূর্বে
প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনেই জানা গিয়েছিল, চালের বাজার মিলাররা নিয়ন্ত্রণ
করেন এবং তাদের কারসাজির পরিসরও বিস্তৃত। চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন-অবরোধের কারণে পণ্য
পরিবহনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে বটে, কিন্তু পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম যেভাবে
বাড়ছে তাতে সিন্ডিকেটের কারসাজির বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ ক্ষীণ। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা
কর্মসূচির পরিসর ইতোমধ্যে বাড়িয়েছে এবং টিসিবির ট্রাকসেলসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডিলারদের
মাধ্যমেও নায্যমূল্যে চাল বিক্রি করছে। কিন্তু এই সুবিধার বাইরে অনেকেই রয়ে গেছেন এ
সংখ্যাও কম নয়। নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসা মোটা চাল। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, তুলনামূলক
মোটা চালের দাম বেশি বেড়েছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে পরিবহন ব্যবস্থা কিছুটা বিঘ্নিত
হয়েছে এই পরিস্থিতি গত দশ দিনের। কিন্তু চালের বাজার এর আগে থেকেই অস্থির হয়ে উঠতে
শুরু করে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি অসাধু ব্যবসায়ীরা মওকা হিসেবে নিয়েছেন।
চাল নিয়ে অতি মুনাফাখোরদের চালবাজি থামাতেই হবে। আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য
চালের দাম ভোক্তার ক্রয়সাধ্যের মধ্যে আনার সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে সময়ক্ষেপণ না
করে। এমনিতেই সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ কতটা চাপের মধ্যে রয়েছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। টিসিবিসহ খোলাবাজারে চালের সরবরাহ বাড়িয়ে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির
পাশাপাশি অসাধু আড়তদার-মিলার-ব্যবসায়ীদের উৎস খুঁজে বের করা জরুরি। সম্প্রতি খুচরা
বাজারে গত বছরের তুলনায় মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিতে মানভেদে দশ-বারো শতাংশ বেড়ে যাওয়ার
কারণ খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্মোহ ও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।
মিলার-আড়তদার কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীদের পরস্পরের দোষারোপের ব্যাপারটিও পুরোনো। আমাদের
অভিজ্ঞতায় আছে, চালের দাম যখন বাড়ে তখন সংশ্লিষ্ট কেউ-ই দায় নিতে রাজি হন না, উপরন্তু
একে অপরকে দায়ী করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অতি মুনাফাখোরদের অপতৎপরতা রোধে অবিলম্বে
কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী ও কার্যকর করা জরুরি।