সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৩৪ এএম
দখলবাজির ধকল সওয়া দায় হয়ে পড়েছে। বলবানদের আগ্রাসী
নজরে ব্যক্তিবিশেষের জমিজমা তো বটেই সরকারি ভূসম্পত্তি দখলের হীনম্মন্য প্রতিযোগিতাও
নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ তার ‘দুই বিঘা’ জমি কবিতায় যথার্থই বলেছেন, ‘এ জগতে হায়,
সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ বলবান কিংবা
রাজাসম প্রভাবশালীদের কী ভয়াবহ গ্রাসে পড়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর জমি!
এই চিত্রই ফুটে উঠেছে ১৩ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে। বলা
হয়েছে, পাউবোর প্রায় সাত হাজার একর জামি বেদখল হয়ে আছে। দখলদাররা প্রভাবশালী এবং বেশিরভাগই
যুক্ত ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে। দখলদারদের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত, তাও সচেতন মানুষ
মাত্রেরই অজানা নয়।
দেশের জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধের অন্ত নেই।
এই বিরোধ যে কেবল ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তি নিয়ে তাই নয়, অনেক সরকারি সম্পত্তি নিয়েও রয়েছে।
এরই খণ্ডিত দৃষ্টান্ত পাউবোর জমি দখল। সারা দেশে পাউবোর অনেক জমি চলে গেছে প্রভাবশালীদের
দখলে। কোথাও কোথাও পাউবো জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে অভিযান চালানোর চেষ্টা অব্যাহত
রেখেছে বটে, কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ দখলকৃত জমি উদ্ধারে অগ্রগতি খুবই কম। দখলকারীরা মাঠপর্যায়ে
যারা ভূমি জরিপের কাজে যুক্ত, তাদের ‘ম্যানেজ’ করে পাউবোর অনেক জমি নিজেদের নামে রেকর্ড
করিয়ে নেওয়ায় এ নিয়ে মালিকানা সংক্রান্ত মামলা থাকায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।
পাউবোর দখল হওয়া জমির মধ্যে বেড়িবাঁধ, ছোট ছোট নদী ও জলাশয়ও রয়েছে।
দখলদাররা পাউবোর জমি দখল করে আবাসিক ভবন, বিপণিবিতান,
মাছের ঘের এমনকি স্কুল-কলেজও গড়ে তুলেছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশের ওই প্রতিবেদনে আরও
বলা হয়েছে, সারা দেশে দখলকৃত পাউবোর জমির বর্তমান মূল্য প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা।
অনেক ক্ষেত্রে এও দেখা গেছে, পাউবো অধিকৃত এসব জমি ভুয়া অবমুক্ত দেখিয়ে ব্যক্তিবিশেষের
নামে রেকর্ড করা হয়েছে। এতে শুধু ভূমির রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের অসাধুরাই জড়িত নয়,
পাউবো এবং স্থানীয় ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজদেরও যোগসাজশ রয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে
পাউবো কর্তৃক পাঠানো তালিকায় এসব তথ্য রয়েছে। বিস্ময়কর হলো, প্রভাবশালী দখলদারদের
উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের নামে ভুয়া কাগজপত্র করে অন্যের কাছে বিক্রিও করে দিয়েছে। এই
প্রেক্ষাপটে পাউবো জোরেশোরে অভিযান চালানোর কথা ভাবছে এবং ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় তারা
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছে। এ ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের
অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে চিঠি ইস্যু করার কথাও জানা গেছে ওই প্রতিবেদনে।
মামলাজটের চাপে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতার
বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। পাউবোর অনেক মামলাও এই কাতারভুক্ত হয়ে পড়ে আছে। সরকারি সম্পত্তি
মানেই জনসম্পত্তি। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের গ্রাসে এই সম্পত্তি থাকতে পারে না। আমরা জানি,
জমি বেদখল বন্ধে সরকার গত সেপ্টেম্বরে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল ২০২৩’ জাতীয়
সংসদে উত্থাপন করে এবং বিলটি পরীক্ষার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী
কমিটিতে পাঠানো হয়। আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষাই নয়, সরকারি
ভূসম্পত্তি অর্থাৎ খাস জমি রক্ষাও। সরকারি ভূসম্পত্তি বিশেষ করে বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের
বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে সরকারের তরফে উদ্যোগ জোরালো করা জরুরি। আমরা দেখছি, সারা দেশেই
বিভিন্ন সংস্থার জমি বলবানদের দখলে চলে যাচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আওতাধীন দখলকৃত
এসব জমি উদ্ধার করে স্ব-স্ব সংস্থার উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে।
তবে বেদখল হওয়া জমির পুনরুদ্ধার ও উচ্ছেদ অভিযানের ক্ষেত্রে পরিবেশগত নিরাপত্তা ও দুর্যোগ
ঝুঁকির বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে আমলে রাখতে হবে।
সংবাদমাধ্যমেই ইতঃপূর্বে উঠে এসেছিল, অনেক সময়
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করা হলেও ওই জমি সংরক্ষণ ও জনস্বার্থে
ব্যবহারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আর শেষ পর্যন্ত জানা যায় না। আমরা মনে করি, অভিজ্ঞতার
আলোকে পুনরুদ্ধার হওয়া জমির যথাযথ সংরক্ষণ, জনস্বার্থে ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারি
সংস্থাগুলোকেই তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে পতিত, খাস, উদ্ধারকৃত জমি কৃষি ও অন্যান্য
খামারের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তও দেওয়া যেতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতায় এও
আছে, জমি উদ্ধারের নামে যে টাকা ব্যয় হয় সেই অনুপাতে জমি উদ্ধারের পরিমাণ নগণ্য। এর
যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এ ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।