× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অধিকার

নাঈম স্কুলে ফিরেছে, কিন্তু জিজ্ঞাসা আছে

মামুন রশীদ

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:০৩ এএম

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম

মামুন রশীদ

মামুন রশীদ

ঈশান আওয়াস্তি, আট বছরের একটি শিশু। আপাতদৃষ্টে খুবই দুষ্টু। পড়ালেখায় মন নেই। সারা দিন আছে নিজের মতো। পাড়ার কুকুরদের সঙ্গে তার দোস্তি। নোংরা পানির মাছ ধরে বয়ামে রাখাতেই তার আনন্দ। ফুল-পাখি-পিঁপড়াদের নিয়ে খেলা। মন নেই শুধু পড়ালেখায়। পড়ার বিষয়গুলো উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। শাস্তি তাই ঘরে-বাইরে প্রতিদিনই নির্ধারিত। বাবা বিরক্ত, মা সন্ত্রস্ত্র। কারণ বাড়ির বড় ছেলে উহান ক্লাসের সেরা ছাত্র। অথচ ছোটছেলে ঈশান সবচেয়ে বাজে ছাত্র। দুরন্তপনা এবং পড়ালেখায় অমনোযোগিতায় ঈশানের বাবা-মা তাকে আবাসিক স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঈশানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় এক আবাসিক স্কুলে। এখানেও মুক্তি নেই। বাবা-মা-ভাই আর পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে কঠোর নিয়মের মধ্যে ঈশান আরও হাবুডুবু খেতে থাকে। তলিয়ে যেতে থাকে একাকিত্বের গহ্বরে। তখন তার জীবনে আলাদিনের দৈত্যের মতো আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেন চারু ও কারু কলার শিক্ষক রামশঙ্কর। স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে থেকেই ঈশান যেন তার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে নিজেকে ফিরে পেতে পারে, সে কাজটিই শুরু করেন শিক্ষক রামশঙ্কর। তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঈশানকে ফিরিয়ে আনেন স্বাভাবিক জীবনে। ঈশানের এ ফিরে আসার গল্পের দেখা মেলে বলিউড চলচ্চিত্র ‘তারে জমিন পার’-এ। আমির খানের পরিচালনা ও প্রযোজনায় ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্তদের সম্পর্কে সহানুভূতি ও সচেতনতা তৈরি হয়।


সমাজে প্রচলিত স্বাভাবিকতার বাইরে থাকা মানুষকে আমরা অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করি। তাদের সুস্থ-স্বাভাব্কি জীবনে ফিরিয়ে আনা আমাদের কাছে গল্প। এরকম গল্পই হয়, জীবনে নয়। নাটক-সিনেমায়ই হয়, বাস্তবে নয়। তাই পর্দায় ঈশানের কষ্টে (যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন) আমাদের চোখ জলে ভরে উঠেছে, তা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে জানান দেওয়ার জন্য যে সহযোগিতা প্রয়োজন ঈশান তা পেয়েছে তার শিক্ষকের কাছে। ফলে সে নিজের ভেতরের প্রতিভাও জাগাতে পেরেছে। কিন্তু সব গল্প তো বাস্তব হয় না। আর হয় না বলেই নাঈম উর রহমানকে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে স্কুলের গেটে। স্কুলে প্রবেশের অনুমতির জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পুরো ১৩ মাস ২৫ দিন। শিশু নাঈম তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নার্সারি ওয়ানে ভর্তি হয়েছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দি বাডস্ রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ভর্তির পর স্কুলের বেতনভাতা নিয়মিত পরিশোধ করলেও একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে স্কুলের উপযোগী নয় বলে বের করে দেওয়া হয়। তার জন্য স্কুলের ফটকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাঈমের স্কুলে প্রবেশের বাধা কী ছিল? স্কুল অধ্যক্ষের ভাষ্য, ‘সে স্কুলের উপযোগী নয়, কথা বলতে পারে না, পেনসিল ধরতে পারে না এবং দুষ্টুমি করে।’ স্কুল অধ্যক্ষের এ সিদ্ধান্ত ছিল দেশের প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের বিষয়টিও অবমাননা এবং অবজ্ঞা করে। স্বাভাবিকভাবেই স্কুলের সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি নাঈমের বাবা। তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিস দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদন করেন।

নাঈমকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে তার পাশে দাঁড়ায় প্রতিদিনের বাংলাদেশ। নাঈমের স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়ে দুটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখে ৮ নভেম্বর তাকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে ও তার ওপর চলমান মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টের ১১ জন সিনিয়র আইনজীবী শিক্ষা সচিব, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিস পাঠান। ১২ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরও স্কুল অধ্যক্ষকে শোকজ করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ১৩ নভেম্বর নাঈমকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। নাঈমের কথা অস্পষ্ট এমন অভিযোগ তুলে যে অধ্যক্ষ নাঈমকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন, ১৫ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেই অধ্যক্ষই নাঈমকে হাত ধরে ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছেন। ‘ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়’। এ যেন সেই প্রাচীন প্রবাদকেই মনে করিয়ে দেওয়া।

নাঈম স্কুলে ফিরেছে। এটা স্বস্তির। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষ এই যে নানামুখী সামাজিক ও আইনি চাপে নাঈমকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলো, এখন তাকে পড়া শেখাবে তো? নাঈমকে স্বস্তিতে স্কুলে থাকতে দেওয়া হবে তো? তার জন্য কি স্কুল কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করবে? নাঈম প্রতিবন্ধী নয়। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘বাচ্চাটি প্রতিবন্ধী নয়।’ অথচ কথা বলার জড়তা এবং কলম ধরায় সমস্যার অজুহাতে এই যে দীর্ঘদিন তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হলো, এর ক্ষত তো সুদূরপ্রসারী। যদিও স্কুলের অধ্যক্ষ বলেছেন, ‘আমি অতীতের বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি নই।’ কিন্তু কথা কি সহজেই শেষ হয়ে যাওয়ার? তিনি যে অন্যায়ভাবে নির্দেশনা অমান্য করে শিশুটিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন, দীর্ঘদিন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করলেন, শিশুর মনে তৈরি হওয়া সেই ক্ষত তিনি মুছবেন কী করে? অধ্যক্ষ অতীতের বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি নন, কিন্তু শিশুটি কি অতীত ভুলতে পারবে?

আজকে শিশুটির স্কুলে ফেরা শুধু নাম-কা-ওয়াস্তে সমাধানমাত্র। এ ধরনের সমাধান দীর্ঘমেয়াদি নয়। নাঈমের বাবা তার সন্তানের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। সংবাদপত্রও তার পক্ষে এগিয়ে এসেছিল। আইনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সহৃদয় আইনজীবীরা। ফলে সে তার অধিকার ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এমন অসংখ্য নাঈমকে অধিকার ফিরিয়ে দেবে কে? তাদের পক্ষে দাঁড়াতে হলে এই ‘অধ্যক্ষ’দেরই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তারা একচক্ষু দৈত্যর মতো। ‘ঠেলায়’ না পড়লে চোখ খোলেন না। স্কুলগুলোর শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষকরা নিজেরা যত দিন না এগিয়ে আসছেন, তত দিন এ সমস্যাগুলো থেকেই যাবে। নাঈমের ঘটনাটি যদি আমাদের বিবেক ও বোধকে জাগায়, আরও পাঁচজন মানুষ সচেতন হয়, তবেই নাঈমদের জয় হবে।

স্কুলের নিয়ম যা-ই থাকুক, তা কখনই রাষ্ট্রের আইনের পরিপন্থি হতে পারে না। সরকারি নির্দেশিকার বিপরীত হতে পারে না। শিশুদের স্কুল কর্তৃপক্ষ ভর্তি নিতে বাধ্য। কোনো অজুহাতেই তাদের ফিরিয়ে দিতে পারে না। নাঈমদের শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে তাই জোরালো দাবি তোলা প্রয়োজন। নাঈমদের মনের কথা শুনতে হবে স্কুল কর্তৃপক্ষকে।

  • কবি, সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা