সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৩ ১২:২৯ পিএম
আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:১৩ পিএম
সাধারণ মানুষ ফের বাজারের চাপে পড়েছে। তাপে পুড়ছে। কয়েকটি নিত্যপণ্যের
দাম একসঙ্গে আরেক দফা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সিংহভাগ মানুষ দিশেহারা। ২৪ নভেম্বর
প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনও এরই সাক্ষ্য বহন করে। চিনি প্রতি কেজিতে
প্রায় ১৫ টাকা, পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতলে ১০ টাকা, দুই কেজি আটার প্যাকেটে ১৫
টাকা বেড়ে যাওয়ায় জনবিড়ম্বনা আরও বেড়েছে। বেড়েছে মসুরডাল, ময়দাসহ আরও কিছু নিত্যপণ্যের
দামও। একই সঙ্গে সবজির ভরমৌসুমেও ক্রেতার নাগালের বাইরে তরিতরকারি!
নিকট অতীতে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা লিখেছি, নিত্যপণ্যের দাম হুটহাট
বেড়ে যায় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। বাজারের নাটাই যারা ঘোরান, অতিমুনাফার লোভে নানা
রকম কারসাজি চালান, তারা সিন্ডিকেটের হোতা বলে সমাজে পরিচিত। অথচ বরাবরই তারা থেকে
যাচ্ছেন প্রতিকার-প্রতিবিধানের বাইরে! বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হয়, নিত্যপণ্যের
ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বাভাবিক চাহিদা কাটছাঁট করেও সংসার চালানো জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের
পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনেকেই নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে অন্য কিছুর দিকে হাত বাড়ানোর
সাহসই পান না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসে প্রতি
কেজি চিনির দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, মসুরডালসহ আরও বিছু
নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার প্রায় কাছাকাছি। আমদানিকারকদের অনেকে ডলার সংকট,
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ইত্যাদি অজুহাত বরাবরের মতোই দাঁড়
করিয়েছেন। অনেক বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদের বক্তব্য, আমাদের বাজার অর্থনীতি ধ্রুপদী
নিয়ম তো মানেই না, উপরন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে অসাধু ব্যক্তিরা ভোক্তার
পকেট কেটে নিজেদের পকেট স্ফীত করতে সুযোগের সন্ধানে ওত পেতে থাকেন।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সুযোগ অদেখা-অধরা সিন্ডিকেটের হোতারা অন্যায্যভাবে
নেবেন, তা হতে পারে না। সিন্ডিকেট শব্দটি আমাদের সমাজে বিশেষ করে বাজারের ক্ষেত্রে
বহুল প্রচলিত। সরকারের দায়িত্বশীলরাও সিন্ডিকেটের কারসাজির বিষয়টি ইতোমধ্যে বহুবার
অকপটে স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সিন্ডিকেটের হোতাদের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও
লম্বা? সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করছেন অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা
দৃশ্যমান নয়, কী বিস্ময়কর! আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার
সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর দায়িত্ব নিয়েও। বাজারে তদারকি কিংবা
নজরদারির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কখনও কখনও তাদের যে অভিযান দৃশ্যমান হয়, এ যেন একেবারেই
‘টোটকা দাওয়াই’। বাজারে দীর্ঘদিন ধরে অসাধুদের যে কারসাজি চলছে এর নিরসনে ‘টোটকা দাওয়াই’-এর
মতো এমন অভিযান যে কার্যত কোনোই ফল দেবে না, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত।
টিসিবি রাজধানীতে কয়েকটি নিত্যপণ্যের ট্রাকসেল শুরু করেছে। তাদের
পরিকল্পনায় আছে, সারা দেশে ডিলারদের মাধ্যমে এই কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানো হবে। আমরা
টিসিবির তরফে এমন পরিকল্পনার কথা এর আগেও শুনেছি। বর্তমানে টিসিবি যে ট্রাকসেল করছে,
তা যেন একেবারেই সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং ভোক্তার
নাভিশ্বাস নিরসনে আমরা বরাবরই বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর তাগিদ দিয়ে আসছি। একই
সঙ্গে জরুরি চাহিদা ও মজুদের নিরিখে আমদানি ব্যবস্থা কীভাবে মসৃণ করা যায়, এ ব্যাপারে
মনোযোগ গভীর করা। ডলার সংকটের বিষয়টি অনস্বীকার্য বটে এবং এ কারণে আমদানি প্রক্রিয়ায়
বিঘ্ন ঘটছে তা-ও অসত্য নয়। কিন্তু ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমের খবরে এ-ও জানা গেছে, কোনো
কোনো পণ্যের চাহিদার নিরিখে মজুদ যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম
অসাধু ব্যবসায়ীদের মর্জিমাফিক বাড়ে। আমরা মনে করি, সর্বাগ্রে ব্যবস্থাপনার গলদ সারানো
জরুরি। একই সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে হবে। সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধে সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল সব পক্ষের নির্মোহ অবস্থান নিয়ে কঠোর প্রতিকার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
যেসব পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয় না, তা-ও কেন ভোক্তার নাগালের বাইরে
এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোরই। দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাও অন্যতম একটি
ত্রুটি। আমরা দেখেছি, ভোক্তা বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হলেও উৎপাদক বা কৃষক ন্যায্যমূল্য
পান না। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হওয়ায় পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও
আগের চেয়ে এখন অনেক সহজ। বাজার ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য জিইয়ে রেখে স্থিতিশীলতার আশা করা
দুরাশার নামান্তর। নানাবিধ দুর্বলতার কারণে তৃতীয় পক্ষ লাভের গুড় পুরোটা খাচ্ছে আর
ভোক্তার অবস্থা নাকাল। বাজারের তাপ-চাপ কমানোর দায় সরকারেরই। ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে
যাতে নিত্যপণ্য কিনতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই হবে।