× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি

আমাদের গৃহবিবাদে বিদেশিদের সুযোগ সন্ধান

ড. ফরিদুল আলম

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৬ এএম

ড. ফরিদুল আলম

ড. ফরিদুল আলম

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভিসানীতি নিয়ে কয়েক মাস ধরে অনেক কথাই হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে এবং এই ভিসানীতি ইতোমধ্যেই কিছুটা কার্যকর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত কারণেই আগামী দিনগুলোতে এটি কতটুকু ও কীভাবে প্রয়োগ করা হবে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সর্বত্রই। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে। গত ১৬ নভেম্বর ঘোষিত এই শ্রমনীতিতে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের অধিকার হরণ, তাদের নির্যাতন এবং ভয়ভীতি দেখানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার নতুন করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপড়েন, আসন্ন নির্বাচন এবং পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে বিষয়টি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করব।

সবার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, আমাদের দেশের পোশাক খাত সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হয়।

শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট শ্রম আইনের আলোকে এর বাস্তবায়নের দায় বর্তায় মূলত মালিক কর্তৃপক্ষের ওপর। তারপরও সরকার, মালিকপক্ষ এবং ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে সার্বিক বিষয়টি পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে চলমান শ্রমিক বিক্ষোভের আলোকে এই ত্রিপক্ষীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য নতুন করে ন্যুনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। এর যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে অর্থাৎ শ্রম আইনের আলোকে তাদের অধিকার হরণ, নির্যাতন অথবা অন্য কিছু, সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কারখানার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সার্বিকভাবে পুরো পোশাক শিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, সরকারের আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের আলোকে আইন প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। সবদিক বিবেচনায় নিলে আমরা যে বিষয়টি দেখতে পাই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রম অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইন কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক। এই বিবেচনায় কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে।

বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ১৭ শতাংশ ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই দেশের বাজারে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে প্রবেশ করা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা সেখানকার বেসরকারি কোম্পানিগুলো, যাদের হাত ধরে তা সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও এককভাবে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বর্তমানে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধার জায়গাটি হচ্ছে শ্রমিকের বেতন বিবেচনায় এদেশ থেকে রপ্তানি করা পোশাকের মূল্য অনেক কম। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২১ দশমিক ২০ শতাংশ, চীনের রপ্তানিও বেড়েছে ১৭ শতাংশ, কিন্তু আয়ের দিক দিয়ে চীন বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। কারণ সে দেশে উৎপাদন খরচ বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। ওই বছর ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে চীনের ৩ হাজার ১৫ কোটি ডলার আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের আয় ছিল ২ হাজার ২৮৮ কোটি ডলার, তবে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে তৈরি পোশাক খাত থেকে বাংলাদেশের আয় ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

উল্লিখিত পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বর্তমান নতুন শ্রমনীতি, যেখানে নতুন করে ভিসানীতি প্রয়োগের হুমকি রয়েছে। বাংলাদেশে এ নিয়ে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছুটা প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফে দফায় দফায় কূটনীতিক প্রেরণ, এদেশে অবস্থানকারী সে দেশের রাষ্ট্রদূতের নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকার এবং বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে দরকষাকষি এবং সবশেষে সংলাপের আহ্বান জানানো এসবই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি প্রেরণÑ এসব কিছুতেও যখন এই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেল না, এ অবস্থায় এই শ্রমনীতি নিয়ে আলোচনার মূল কারণ এই যে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নতুন কোনো উপায়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কি না সেই সংশয়। এর মধ্যে খবর ছড়িয়েছে, ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ এই শ্রমনীতির টার্গেটে পরিণত হতে পারে বলে সতর্ক করা। কূটনৈতিক পর্যায়ে যখন এ ধরনের বার্তা আদান-প্রদান করা হয়, তখন এর গুরুত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘দেশের মানুষের ভক্তি কম, গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে যায়।’ মন্ত্রীর বক্তব্যের আলোকে বিনীতভাবে বলতে চাইÑ প্রথমত, সাংবাদিকরা তাদের সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই কাজ করেছেন। এটি যদি গোপন তথ্য হয়ে থাকে তাহলে সরকারসংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সঠিক মনযোগের অভাব রয়েছে; দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে কী এমন গোপনীয়তা রয়েছে, যার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে? বরং তা আমাদের মধ্যে অনেক ভাবনার খোরাক দিতে পারে, যার কিছুটা এই লেখায় উল্লেখ করেছি অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে এদেশ যতটা না লাভবান হয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছে সে দেশগুলো।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তৈরি পোশাক রপ্তানির দিক দিয়ে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অথচ চীনের অভ্যন্তরে রয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ, এখানে কেবল তৈরি পোশাকের দিকটি বাদ দিলে সার্বিক উৎপাদনের দিকে যদি মনযোগ দিই, তাহলে এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, বৈদেশিক রপ্তানিতে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থান দখন করে আছে। বিশ্বের সব নামিদামি এবং বিলাসী পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য চীনকে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রেখেছে উন্নত সব দেশ। যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মতাদর্শগত ব্যাপক অমিল, সেখানকার সাধারণ মানুষের স্বার্থ এবং প্রয়োজন বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার চীনের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সাহস পায় না। অথচ দেশটিতে শ্রম অধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নন-কমপ্লায়ন্সের অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে কেবল এই শ্রমনীতির আলোকে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হবে, এটা যদি সত্য হয় তাহলে ভাবতে হবে যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের প্রয়োজনকে সাময়িকভাবে বিসর্জন দিয়ে তাদের মতো করে আমাদের রাজনীতি সাজাতে চাইছে। বিষয়টি আসলে এতটা সহজ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতগুলো অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে সে দেশের সরকারকে কোনো নির্দিষ্ট দেশকে ভিসানীতির আওতায় আনতে হলে বেসরকারি খাতের স্বার্থে তা আঘাত করলে তাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে হঠাৎ করে শ্রম স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন কোনো কিছু ঘটে যায়নি, যার মধ্য দিয়ে এদেশের ক্ষেত্রে তাদের নতুন ঘোষিত শ্রমনীতি প্রয়োগযোগ্য হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের অসন্তোষ আমলে নিলে নিজেদের মনে কিছুটা প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, এর পেছনে তাদের পরোক্ষ কোনো ইঙ্গিত ছিল কি না।

দেশে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাদের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। দেশের বর্তমান নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩২টি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাকি ১২টি দলের মধ্যে একমাত্র বিএনপি বাদে সে রকম উল্লেখ করার মতো কোনো দল নেই। সে বিবেচনায় নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে এতদিন ধরে মার্কিন সরকারের দিক থেকে যে তাগিদ ছিল, সেটা অনেকাংশেই পূরণ করা হয়েছে। এতগুলো দলের সরব উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করছে যে, নির্বাচন নিয়ে এতদিন ধরে বিএনপির দাবিগুলোর মধ্যে আসলে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনে অংশ্রগ্রহণ না করে তারা গত ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনা ঘটানোর পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে ২১৭টি যানবাহন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতদিন ধরে যে যুক্তরাষ্ট্র সঠিক নির্বাচন এবং বিএনপির দাবিগুলোকে আমলে নেওয়ার জন্য ওকালতি করে আসছিল, গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বিচ্ছিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ড নিয়ে তারা কোনো শব্দ উচ্চারণ করছে না! এর মধ্য দিয়ে তারা এটিই স্পষ্ট করেছে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিপরীতে তারা আসলে চায় এমন কোনো সরকার বাংলাদেশ পরিচালনা করুক, যারা তাদের প্রতি অনুগত থেকে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে, যেখানে তাদের অপছন্দের কোনো দেশ কিংবা কোনো কাজে সরকার অংশ নেবে না।

মনে রাখা দরকার, বাইরের শক্তিগুলো তখনই তাদের তৎপরতা দেখানোর সুযোগ পায়, যখন ঘরের ভেতর গৃহবিবাদ চাঙ্গা হয়। নির্বাচন বর্জন করে, জনগণের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কিংবা বিশ্বাস না রেখে, কেবল যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখা যে আসলে আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দেওয়ার শামিল, দেশের মানুষ এ ব্যাপারে এখন বেশ সজাগ। আর তাই এই শ্রমনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষকে ভয় দেখানোর প্রয়াস এক অপপ্রয়াস বৈ কিছু নয়।

  • কূটনীতি-বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা