আর্থিক খাত
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৩ এএম
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:১২ পিএম
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বিবিএসের এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ২০২২-২৩
অর্থবছরে আর্থিক কার্যক্রমের প্রবৃদ্ধি প্রায় পুরো সময়জুড়েই ছিল শুন্য। আর্থসামাজিক
প্রেক্ষাপটেও দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট দেশের নাগরিক সমাজের বৃহদাংশের দৈনন্দিন
কার্যক্রমের গতি কমিয়ে দিচ্ছে এবং জীবনযাত্রায় টান পড়েছে। কর্মসংস্থানের অভাব, মূল্যস্ফীতি,
বেকারত্ব, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কিংবা সুযোগ-সুবিধা
না পাওয়ায় মানুষের যাপিত জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে এবং তা ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক
অর্থে। বাজারব্যবস্থায় অসামঞ্জস্য এবং মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার মান অনেক কমে
গেছে। অতীতে কৃচ্ছ্রসাধন করে হলেও মানুষ টিকে থাকতে পেরেছে। কিন্তু এখন তা বহুলাংশে
কঠিন হয়ে পড়েছে। অল্প খেতে হচ্ছে এবং খাবারের মানও আগের তুলনায় খারাপ। মানুষের জীবনে
ভোগান্তির বিভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ
দেখে মানুষের মনে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, অর্থনীতি ভুলপথে চালিত হচ্ছে। ধারণাটি
যে ভুল নয় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বিবিএসের পর্যবেক্ষণ। তা ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সংকটেও
অর্থনীতির নানা খাত প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে।
ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, শিল্প খাতের উৎপাদন
কমে যাওয়াসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষের আর্থিক কার্যক্রম কমে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতের
ঋণপ্রবাহও সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত ৩১ মাসের মধ্যে এই প্রবাহ দুই অঙ্কের নিচে
নামার রেকর্ড গড়েছে। একদিকে যখন ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ ছাড়, ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন
ও সুদ মওকুফের ছড়াছড়ি; অন্যদিকে তখন চলে দেশের গরিব কৃষকদের মামলা দিয়ে ঋণ আদায়ের কঠিন
তোড়জোড়। এই পরিস্থিতিও নতুন কিছু নয়, বরং পুরোনোই। দেশের ব্যাংক খাতজুড়ে এমন দুমুখো
নীতিই চলে আসছে বছরের পর বছর। দুমেুখো নীতির বহুমুখী বিরূপ ফল সমাজে নেতিবাচকতার ছায়া
আরও বিস্তৃত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকঋণের যত টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে তার
বেশিরভাগই পেয়েছেন বড় বড় ঋণগ্রহীতারা। আর অল্প টাকার দায় নিয়ে বহু কৃষকের হাতে পরানো
হয়েছে হাতকড়া। আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষিখাত আর কৃষক হলেন অন্যতম শক্তি। অথচ
তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই।
ঋণখেলাপিদের বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গড়ে
তোলা সম্ভব হয়নি। কীভাবে ঋণ আদায় করা হবে এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কী কী
উদ্যোগ নিতে পারে তা-ও স্পষ্ট করা হয়নি। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণও বাড়তে শুরু
করেছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণে তেমন সমস্যা না হলেও স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলোয় চাপ পড়বে। বড়
বিষয় হচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরে শর্ট টার্ম লোন অনেক বেশি। এগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের
দায়িত্ব। কিন্তু সেখানেও ডলার প্রয়োজন। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে ডিফল্টার হলে তা ইতিবাচক
বার্তা দেয় না। নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাই বারবার ভাবতে হবে। বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয়
ঋণ নেওয়াই উচিত নয়। এগুলোর গ্রস পিরিয়ড কম, সুদ বেশি। অর্থনীতিতে সুবিবেচনার জায়গাগুলোকে
প্রাধান্য দিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত আরও বড় ঝুঁকির মুখোমুখি হবে।
এমনিতেই যে ঝুঁকিতে রয়েছে অর্থনীতি, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে সুপারিশ করা হচ্ছে।
কিন্তু কতটা তা আমলে নেওয়া হচ্ছেÑ এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আমাদের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। চলমান রাজনৈতিক
সংকটে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়ছে। বিদ্যমান সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে
হচ্ছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের বিকল্প নেই। অর্থনীতিতে
তথ্যভিত্তিক সমাধান এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের পথ সহজ রাখতে হবে। যেকোনো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের
একার ওপর দায় চাপিয়ে দিলে সংকট মেটে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে আরও
সতর্ক হতে হবে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রতিষ্ঠানকে তারা নজরদারির
মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট হবে এবং
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি ও কার্যপদ্ধতি হবে সমন্বিত। এভাবেই আমাদের অর্থনীতি
সুসংহত করা যেতে পারে চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রেক্ষাপটে। রাজস্ব আদায়
এবং ব্যবস্থাপনার জন্য এনবিআরকে পদক্ষেপ নিতে হবে নির্মোহভাবে। বাজারব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা ও কার্যক্রম
নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। বাণিজ্য নীতিমালা এবং দায়িত্বশীল সংস্থার জন্য সবকিছুই স্পষ্টভাবে
উল্লেখ আছে।
যেকোনো নীতি বা কৌশল যদি আমরা বিশ্লেষণ করতে
চাই, তাহলে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন হবে। আর তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই দক্ষতাভিত্তিক কৌশল
গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা বলি, আমাদের দেশে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। প্রশ্নও দাঁড়ায় বিদ্যমান বাস্তবতা কী বলছে। প্রকৃত
বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। মুক্তবাজারে সরকারের নীতিমালা থাকবে। সেই নীতিমালা অনুসারে
পরিচালিত হবে বাজার। ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সরকারকে সমন্বয়কারীর
ভূমিকা পালন করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাজার মনিটরিং এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
নেওয়ার বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দৃশ্যমান নয়। বহির্বিশ্বে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা
হয়। অথচ আমাদের বাজারের তথ্য আমরা পাই না। অর্থনীতির জন্য এটি ভালো কোনো কিছু হতে পারে
না। দেশের বাজারের গতিবিধি ক্ষমতাধর গুটিকয়েক নীতিহীন ব্যবসায়ীই নির্ধারণ করেন। অর্থনীতির
হিসাবে বাজারের যে গতি থাকার কথা তা অনুপস্থিত আমাদের বাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এক্ষেত্রে
অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাচারিতার পরও বাজার নিয়ন্ত্রণের মতোই নীতি জিইয়ে রেখেছে।
বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দাবি নানা মহলের।
জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের স্বার্থে এর বিকল্পও নেই। জনজীবনে স্বস্তি ফিরলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের
পথও সহজ হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতি দিতে
হবে।
ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অব্যবস্থাপনার
ছায়া ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ব্যাংক খাত ঘিরে গ্রাহকের আস্থার
পারদ ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। আমরা দেখছি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে
ডলার সংকট। এ কারণে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে সম্পৃক্ত পণ্য আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ
ব্যাংক ডলার সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে এ ব্যাপারে চিঠি
দিয়েছে বলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ। শুধু তাই নয়, সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি ৪৩টি ব্যাংকের
খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার বার্তা উঠে এসেছে প্রতিদিনের বাংলাদেশের একটি
প্রতিবেদনে। সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।
আর্থিক খাতে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতির বিষফোড়া। আর্থিক খাতে সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করা গেলে এ সংকট দেখা দিত না। উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার পরিণাম আর্থিক
খাতেও নেতিবাচক প্রভাব রেখে চলেছে। আমরা দেখছি, রাজস্ব আয়-ব্যয়ের যে তথ্য সংশ্লিষ্ট
প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করে তার মধ্যে অনেক ঘাটতি থেকে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া
অনেক তথ্যই অনেক সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে আর্থিক খাতে
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি রয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গড়ে তোলা এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন তা অনুসরণ করে, তা
নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি
করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ছেড়ে দিলে চলবে না।
খেলাপি ঋণের ব্যাপারে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা-অঙ্গীকারের কথাও নানা মহল থেকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু কার্যত এ ব্যাপারে কোনো কিছুই দৃশ্যমান নয়। তাও মূলত সমন্বয়ের অভাবেই ঘটছে। সমন্বয়হীনতার ফলে আর্থিক খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা জিইয়ে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্ত। ঋণ দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ওপর মহলের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা আর আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে। শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছাই অর্থনীতিকে সুসংহত করতে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। বিশেষত রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করে নির্মোহ অবস্থান নিয়েই নীতিনির্ধারকদের করণীয় সম্পর্কে ভাবতে হবে।