× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্বাচন

রাজনৈতিক বৈরী হওয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন

ড. মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৭ এএম

ড.  মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

ড. মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপি এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকার পতন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনকারী আরও কয়েকটি বলতে গেলে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল একই দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। জামায়াত প্রকাশ্যে যুগপৎ আন্দোলনকারীর খাতায় নাম লেখায়নি, কিন্তু বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় ছিল। বিএনপি ও জামায়াতের কৌশল ছিল আওয়ামী লীগকে অন্য সব রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে দলটি বাধ্য হবে তাদের দাবি মেনে নিতে। দুদিন আগে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামায়তকে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক করতে বিএনপির মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কিছুতেই নির্বাচনে জয়লাভের আশা না দেখার অবস্থান থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই মুখ্য দাবিতে পরিণত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না, এও তারা বারবার বলে আসছিল। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী এ দুই দাবির কোনোটিই নির্বাচনের জন্য এখন আর প্রযোজ্য নয়। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের দাবি হলো সংবিধান পরিবর্তন করা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে রায় দেওয়ার পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে তা অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা দুরূহ। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে রিভিউ পিটিশন দায়ের এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ীই কেবল ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তা করা না হলে বিষয়টি সাংঘর্ষিক হতে বাধ্য। তবে এখন তাও অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে কারণ নির্বাচনের ট্রেন চলমান।

সংবিধানে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু থাকতে পারে না। তার পরও বিএনপি আশা করেছিল দেশে প্রবল জনমত সৃষ্টি করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা যাবে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা এক বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় জনসভা, পদযাত্রা, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করায় তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছিল। অনেকেরই ধারনা ছিল বিএনপি যতই সরকার পতনের আন্দোলনের কথা বলুক না কেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কারণ গত এক-দেড় বছরে বিএনপি অনেকটাই সংগঠিত হয়। এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপি হয়তো আশাতীত কিছু ফলও পেত। কিন্তু বিএনপিতে হাইকমান্ড বলে কিছু নেই, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে। লন্ডনের হিসাবনিকাশের সঙ্গে দেশের বিএনপির হিসাবনিকাশে যথেষ্ট ফারাক। বিভিন্ন ঘটনা ও আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণও পাওয়া গেছে। ২৮ অক্টোবরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আন্দোলনের আগের ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ২৮ অক্টোবর থেকে সরকার উৎখাতে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীরা প্রস্তুত হয়েই যতসব দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। স্বভাবতই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশ-জাতির স্বার্থে সঙ্গতই আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। বিএনপি আশা করেছিল এ অবস্থায় বিদেশিরা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু বৈরি অবস্থানের পরও পিটার হাস শর্তবিহীন আলোচনায় বসার কথা উল্লেখ করলেও বিএনপিই তার প্রতি কর্ণপাত করেনি। আওয়ামী লীগও আগে শর্তহীন আলোচনার কথা বলায় বিএনপি তা নাকচ করে যুগপৎ আন্দোলনকারীরা তফসিল ঘোষণা না করার দাবি করে আসছিল। তত দিনে হরতাল, অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, মানুষ ও সম্পদ পোড়ানোর ঘৃণ্য অনেক ঘটনা ঘটানো হয় যা এখনও চলমান। নির্বাচন কমিশন ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা হরতাল এবং অবরোধের বৃত্তে ঘুরতে থাকেন। 

বিএনপির অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে কিংবা আটক হয়ে কারাগারে চলে গেলেন। বিএনপির হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে রাস্তায় গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতাকর্মীকে দেখা গেল। এর পরও অনেকে আশা করেছিলেন বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মতি দিলে কমিশন পুনঃতফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকল। নির্বাচনী ট্রেন চলতে শুরু করার পরও তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছিল। এর মধ্যে সরকার পতনের কয়েকটি ডেডলাইনও দেওয়া হয়েছিল, কিছু একটা ঘটে যাওয়ারও হুমকিধমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগ যখন বুঝতে পারে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তখন নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় সেজন্য দলের মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়টিও উন্মুক্ত করে দেয়। প্রায় ২৭-২৮টি দলের মনোনীতরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। বলা হয়েছিল, ১৭ ডিসেম্বর কিছু একটা হয়ে যাবে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কিছু একটা করার পরিকল্পনা থাকার বিষয়টি অনেকের কাছেই সন্দেহ ছিল। জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ছিল সন্দেহও। শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার ব্যবস্থা করল। ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের মেঘ কেটে গেল। প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনে ১ হাজার ৮৯৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতায় টিকে রইলেন।

নির্বাচন এখন মোটামুটি জমে ওঠার আভাস-ইঙ্গিত চার দিক থেকে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি আন্দোলনে হরতাল-অবরোধ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। রেলে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন কাটাকাটি, উপড়ে ফেলা, ফিসপ্লেট ফেলে দেওয়া ইত্যাদি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর ফলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এ পর্যন্ত পাঁচ রেলযাত্রী পুড়ে মারা যান। অনেকেই আহত হন। ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানো হয়েছে তাতে জড়িত অনেককেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বিএনপির আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথ হারিয়ে গুপ্তহামলা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতামূলক চরিত্রের হওয়ায় বিএনপির প্রতি যারা একসময় সদয় হয়েছিলেন তাদেরও অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন—এমন খবরও সংবাদমাধ্যমেই এসেছে। নির্বাচনী ট্রেন এখন বলতে গেলে শেষ গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এ অবস্থায় ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা সবাই বিশ্বাস করেন। বিএনপির দেওয়া ডেডলাইন, আল্টিমেটাম, হুমকিধমকিও খুব একটা কাজে লাগেনি। দেশ এখন নির্বাচনের আবহে প্রবেশ করেছে। নির্বাচনী প্রচারে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা বাড়ার প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে কালক্ষেপন না করে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নতুন কর্মসূচি দেবে এমন কথা শোনাচ্ছিল। কিন্তু লন্ডন থেকে কর্মসূচির যে ওহি জারি করা হয়েছে, তা শুনে রাজনীতিসচেতন অনেকেই বিস্মিত ও হতবাক। বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সবাইকে খাজনা, ট্যাক্স, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল না দেওয়ার কথা তিনি বলেছেন। সরকারকে কেউ যেন সহযোগিতা না করে সে কথাও রিজভী জানিয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন আন্দোলনের মূল নেতার যেকোনো নির্দেশ পালন করার জন্যই জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে, যা আমরা দেখেছিলাম ১৯৭১ সালের মার্চে। বঙ্গবন্ধু তখন যা বলেছিলেন, জনগণ তা-ই করেছিল। অফিস-আদালত বন্ধ ছিল, ব্যাংক কয়েক ঘণ্টার জন্য খোলা থাকত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ ছিল। ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও অসহযোগ অব্যাহতই ছিল। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর মতোই সবাইকে খাজনা-ট্যাক্স, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস বিল না দেওয়ার, অফিসে কাজ না করার, সরকারকে সহযোগিতা না করার যে আহ্বান জানিয়েছেন এর সঙ্গে বিএনপিরই কতজন প্রকৃতার্থে সহমত পোষণ করেন—এই প্রশ্নও উঠেছে। তারেক রহমান বিএনপির আটক নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না দেওয়ারও কথা বলেছেন। হাজিরা না দিলে নেতাকর্মীদের কারাবাস দীর্ঘমেয়াদি হবে। গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ বিল না দিলে অন্ধকারে, গ্যাসবিহীনভাবে এবং ওয়াসার পানি ছাড়া থাকতে হবে। বিএনপির নেতাকর্মীরা কি তা করবেন? 

বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী তারেক রহমানকে ‘রাষ্ট্রনায়ক’ বলে অভিহিত করে থাকেন। সেই ‘রাষ্ট্রনায়কের’ ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির ফলে তাকে কতটা ‘রাষ্ট্রনায়কোচিত’ নায়ক হিসেবে জনগণ মানবে বা মেনে নেবে তা বড় প্রশ্ন। বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পন্থায় কিংবা গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুসারে আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ছাপ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের ডাক জনগণ কিভাবে গ্রহন করে সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে ত্রাস সৃষ্টি করে, গণতান্ত্রিক সংজ্ঞাসূত্র অবজ্ঞা করে রাজনৈতিক কোনো অর্জন যে হয় না, এ নজিরও আমাদের সামনে আছে। 

  • শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা