× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অর্থনীতি

মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তিবিপ্লব

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম

মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তিবিপ্লব

গল্পের আগেও গল্প থাকে।

১৯৯৭ সালের দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ‘ভিলেজ পে ফোন’ নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ হাতে এসে গেল। গ্রামের গরিব মহিলাদের হাতে অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তিটি তুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে এই সেবা বিক্রি করে তারা পেট চালাতে পারেন। গবেষণা যখন শুরু করি, তখন সারা বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সংখ্যা ডুমুরের ফুলের মতো কিংবা কল্পনায়, আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। এমন এক অবস্থায় ঢাকার আশপাশে মাত্র ১১টি গ্রামে দুস্থ মহিলাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয় গ্রামীণ ফোন কোম্পানি। সেটা ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের নবধারামূলক চেষ্টা– ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গরু বা ছাগল কিংবা হাঁসমুরগি না দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি মোবাইল ফোন-সেবা বিক্রির ব্যবস্থা করা। সেই সময় মোবাইল ফোন হাতে থাকার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে-বিদেশে যোগাযোগ রক্ষা করা; খবর কী, আসবেন কবে, টাকা পাইছেন কি না, বাজারের অবস্থা কেমন ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথোপকথন ছিল খেজুরে আলাপ, তবে অর্থনৈতিক বিষয় বাদ যায়নি। এরই মধ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা দিয়ে; সরকারের ইতিবাচক নীতিমালায় মোবাইল ফোন হাতের মুঠোয় যোগাযোগের মধ্যমণি হয়ে উঠল। এখন সারা দেশে নাকি প্রায় ৯০ ভাগ খানায় অন্তত একটা ফোন আছে। আর এই এলাহিকাণ্ডের কান্ডারি মোবাইলসেবা নিয়ে গবেষণাধর্মী একটা পুস্তিকা রচনা করেছে বিআইডিএস– গবেষকরা হলেন কে এ এস মুরশিদ, শহিদ খন্দকার, খোন্দকার সাখাওয়াত আলি, হুসাইন সামাদ ও মনজুর হোসেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত বইটিতে পাওয়া যায় এমএফএসের ধনাত্মক ভূমিকায় নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস।

 

দুই

বলা বাহুল্য, বেশ অল্প সময়ের মধ্যে এবং দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়। টাকার অঙ্কে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালের জুলাইতে দাঁড়ায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার সেবা। মোট কথা, এমএফএস আর্থিক বাজার তাৎপর্যপূর্ণভাবে গভীরতর করেছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত আছে বিভিন্ন পণ্য পরিবেষ্টিত সেবা। প্রথম দিকে একজন আরেকজনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন প্রাধান্য পেলেও অধুনা বেতন, স্কুলের বৃত্তি প্রদান এবং অনলাইন আর অফলাইনে বাণিজ্যিক দেনাপাওনা, বিভিন্ন বিল এবং হকারের পাওনা পরিশোধ সবই মোবাইল ফোনের কল্যাণে বেশুমার চলছে।

বাংলাদেশের বাজারে অনেক এমএফএস সেবা দিয়ে গেলেও কিন্তু মাত্র দুটো এমএফএস বাজারের সিংহভাগ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে; এখন পর্যন্ত ‘বিকাশ’ নামে প্রতিষ্ঠানটি বিকশিত হয়ে বাজারের নেতৃত্বে আসীন। ব্র্যাক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হিসেবে বিবেচিত বিকাশ ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ (শেয়ার ৩৮ ভাগ) এই দুই প্রভাবশালী সেবাদাতা নিয়ন্ত্রণ করে বাজারের ৯৪ শতাংশ সেবা। বলতে দ্বিধা নেই যে সাধারণ আলোচনায় এখন এমএফএস বলতে মূলত বিকাশকে বোঝায়, যার আক্ষরিক অর্থ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠানো এবং পাওয়া।

খানাভিত্তিক সমীক্ষায় জানা যায়, গ্রামীণ কমিউনিটির সেবায় নিয়োজিত আছে মূলত তিনটি এমএফএস জোগানদার যথা বিকাশ, রকেট এবং সিউরক্যাশ। যদিও গ্রামীণ খানার প্রায় শতভাগের অন্তত একটা মোবাইল ফোন আছে, কিন্তু এমএফএসে হিসাব আছে মাত্র ৩৮ শতাংশের। মোবাইল ফোন আছে এমন খানার ৬৮ শতাংশ কোনো না কোনো এমএফএস ব্যবহার করে এবং এদের অর্ধেকের মতো সংযোগ রাখে বিকাশের সঙ্গে। গ্রামবাংলার লোকজন ১৪ শতাংশ টাকা লেনদেনে বিকাশ ব্যবহার করেন (১৬% পুরুষ, ১২% নারী)।

 

তিন

যা-ই হোক প্রাপ্ত বা পাঠানো টাকার তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে সিংহভাগ খরচ হয় ভোগে, স্বাস্থ্যে ৪ শতাংশ এবং শিক্ষায় ৬ শতাংশ। বিকাশ যেহেতু ধনী-গরিবনির্বিশেষে জনপ্রিয় মাধ্যম, বিশেষত গরিবের ভোগসহায়তা তথা দারিদ্র্য হ্রাসে এর ভূমিকা ব্যাপক বলেই অনুমান করা যায়। সব এমএফএসের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ প্রাপ্ত হয় জেলার বাইর থেকে (নারী ৭০%, পুরুষ ৬৪%)।

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খানা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছে গড়পড়তা ৯ বার, বছরে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। সব এমএফএসের চিত্র মোটামুটি একই হবে, যেখানে বিকাশের অনেকটা অপ্রতিরোধ্য আধিপত্য বিদ্যমান। কী কী উপাদানের ওপর গ্রামীণ খানাগুলোর এমএফএসে অংশগ্রহণ নির্ভর করে?

জানা যায়, খানাপ্রধান পুরুষ হলে বিভিন্ন আর্থিক এমএফএস ও অন্য এক সেবায় হিসাব খোলার সুযোগ গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি থাকে; হিসাব খোলার ব্যাপারে শিক্ষার স্তরও একটা নিয়ামক; তেমনি নিয়ামক খানাপ্রধানের বয়স, ব্যাংক অথবা বিকাশে হিসাব খোলায়। অন্যদিকে ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ, সম্পদলভ্যতা নির্ধারণ করে হিসাব খোলা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত। মজার কথা ভূমিসম্পদ বেশি যাদের তাদের ব্যাংক বা বিকাশে হিসাব খোলার সম্ভাবনা কম অথচ ভূমিবহির্ভূত সম্পদের মালিকানা ইতিবাচক প্রভাব রাখে হিসাব খুলতে।

 

চার

এটা সত্যি যে মোবাইল ফোনের মালিকানা এমএফএস হিসাব খোলার জন্য দরকার, তবে মোবাইল ফোনের ভেতর স্মার্টফোনের চাহিদা অধিকাংশ এমএফএস খদ্দেরের। উদাহরণস্বরূপ নিয়মিত ফোনের ২৩ শতাংশ পয়েন্টের বিপরীতে খানায় একটা স্মার্টফোন থাকলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি ঘটে ২৯ শতাংশ পয়েন্ট। একইভাবে স্মার্টফোনের মালিকানা বিকাশের অ্যাকাউন্ট খোলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে ২২ শতাংশ পয়েন্ট যেখানে নিয়মিত ফোন করে ১০ শতাংশ পয়েন্ট।

এমএফএস বিভিন্নভাবে খানার কল্যাণ বৃদ্ধি করে। প্রথমত. দক্ষ, দ্রুত এবং নিরাপদ অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে বিকাশের মতো এমএফএস-সেবা খানার সম্পদ দক্ষতা আনয়ন করত খানার আয়, ভোগ এবং অন্যান্য নির্দেশকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 

পাঁচ.

দ্রুত অর্থ আদান-প্রদানে সাহায্য করার মাধ্যমে এমএফএস খানার ধাক্কা বা শকজনিত সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলে। তিন. বিকাশের মতো এমএফএস সনাতন পদ্ধতিতে যেমন লোকমারফত কিংবা কুরিয়ারে অর্থ হস্তান্তরের বিপরীতে সুলভে বিনিময় ঘটাতে পারে এবং এতে কম সময়ের ভেতর অধিক লেনদেন সম্পাদন সম্ভব হয়। তবে গ্রামে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের এজেন্টের উপস্থিতি, যেমন বিকাশের, এর ব্যবহার বৃদ্ধি ঘটায় প্রায় ৫ শতাংশ পয়েন্ট। অবশ্য অন্যান্য এমএফএসের জন্য এই সম্পর্ক খানিকটা দুর্বল। এবং বলা বাহুল্য, বিকাশের কারণে খুব দ্রুত লেনদেন খানাগুলোকে ধাক্কা সামলাতে সাহায্য করে, যা আবার ঝুঁকিÑ অংশীদারিত্ব আয় ও ভোগের ওঠানামা হ্রাস করে।

এমএফএস খাতে প্রধান ভূমিকায় আছে নারী। শ্রমবাজারে বিশেষত শহরের কলকারখানা কিংবা খানায় তাদের উপস্থিতি, প্রেরক এবং প্রাপক উভয় কারণে, এমএফএস ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে। নারীদের একটা বড় অংশ বাড়িতে বসে শহর থেকে পাঠানো অর্থ হাতে পায়। এবং এতে করে তাদের ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সিদ্ধান্তে, বৃদ্ধি পায়। অতএব বলা চলে যে, বিকাশের মতো এমএফএস শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর শ্রম, বাজারভিত্তিক উপার্জন, অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণ এবং খানার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

 

পাঁচ

দুই-তিন বছর আগে বিকাশের খদ্দেরের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটি, যাদের মধ্যে সক্রিয় প্রায় ২ কোটি। সারা বাংলাদেশে ২ লাখ ২০ হাজার এজেন্ট নিয়ে বিকাশের বার্ষিক লেনদেন ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের সমুদয় অর্থনীতির ১১ শতাংশ (২০১৭ সালের ২৫০ বিলিয়ন ডলার সাপেক্ষে)। মূলত অর্থনীতিতে বিকাশ যে ভূমিকা রাখছে তা হলো লেনদেনে বিনিময় ব্যয় হ্রাস করে অর্থনীতির দক্ষতা বৃদ্ধি। খদ্দেরের নিট লাভ আসে ৪ শতাংশ এবং ২৭ বিলিয়ন ডলারের সমগ্র অর্থনীতিতে উপকারিতার পরিমাণ প্রায় ৮৭ বিলিয়ন টাকা বা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। যদি জিডিপি ধরা হয় ২৫০ বিলিয়ন ডলার, তখন অর্থনীতিতে বিকাশের কর্মকাণ্ডের অবদান দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, বর্তমান জিডিপির হিসাবে তা ১ শতাংশের বেশি হবে।

মোটকথা বিকাশ (বাজারের অর্ধেক শেয়ার) এবং অন্যান্য এমএফএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তিবিপ্লব ঘটেছে বলা যায়। মানুষ যেমন প্রতিনিয়ত একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, সামাজিক খাতে উন্নতি ঘটছে, বিনিময় ব্যয় হ্রাস করে একটা দক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সরকারের উচিত হবে যথাযথ নীতিমালার মাধ্যমে এমএফএস উৎসাহিত করা, যাতে ভুঁইফোড় এমএফএস টাকা পাচারে লিপ্ত হতে না পারে।

আগে একজন রিকশাচালক মাসের শেষে কুড়িগ্রামের বাড়ি গিয়ে পরিবারের কাছে টাকা দিতেন আর এখন কয়েক মিনিটের মধ্যে টাকা পৌঁছে তার পরিবারের কাছে। এমএফএস ধনী-গরিবনির্বিশেষে সেবা দিয়ে যাচ্ছে; বিকশিত হোক বিকাশ এবং অন্যান্য এমএফএস।

 

 

  •  অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা