× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনৈতিক সহিংসতা

মানুষ কি শুধুই প্রাণীমাত্র

মামুন রশীদ

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:০৩ এএম

আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৯:২৬ পিএম

মামুন রশীদ

মামুন রশীদ

আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া একটি চুড়ি ঝুলছে। সেই চুড়িটির দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন একজন প্রবীণ। ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘পোড়া চুরি। ছিল কোনো মায়ের বা বোনের হাতে’। ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ফটোসাংবাদিক আলী হোসেন মিন্টুর তোলা ছবিটি আরও একবার বুকের ভেতরটা মুচড়ে দিল। ৫ জানুয়ারি ঢাকার গোপীবাগে গন্তব্যে পৌঁছার কিছুক্ষণ আগে ট্রেনে আগুন দেয় দুষ্কৃতকারীরা। দাউদাউ করে জ্বলছে ট্রেনের বগি। ছাই হয়ে যাচ্ছে বেনাপোল এক্সপ্রেসের কয়েকটি কোচ। সে ছবি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে। আগুনে পুড়ে প্রাণ যায় চারজনের। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর ট্রেনে আগুন ও নাশকতায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯-এ।

এ মর্মান্তিক মৃত্যু নতুন করে প্রশ্ন দাঁড় করায়- ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার রাজনীতির কাছে মানুষ কি আজ শুধুই সংখ্যা? শাসক ও বিরোধী দলের রোষানলে দগ্ধ হয়ে কেন বারবার সাধারণ মানুষকে পুড়ে মরতে হবে? যে শিশু আজকে তার মাকে হারাল, তাকে কে দেবে সান্ত্বনা? আর সান্ত্বনায় কি সে তার মাকে ফিরে পাবে? তার দিন কাটবে? আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে পুড়তে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের জানালায় আটকে পড়া মানুষের শেষ উক্তিটিও কি আমাদের পোড়ায়নি? অথচ জ্বলন্ত ট্রেনের জানালায় আটকে পুড়তে থাকা ছবিতেও হাহাহা রিঅ্যাক্ট দেখেছি। সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্নও তুলেছেন, ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন গোপীবাগে কেন?’ অথচ হাহাহা রিঅ্যাক্ট দেওয়া এবং প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের কারওই হয়তো মনে হয়নি, পুড়িছে ‘সন্তান মোর মার’।


ট্রেনে আগুন লাগা এবং সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ আগুন কি আমাদের হৃদয় দগ্ধ করতে পারে না? আমাদের বোঝাতে পারে না, ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে দাঁড়াও’। ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যেমন সুযোগ নেই আগের ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার ফিকির না খুঁজে যদি প্রতিটি ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত হতো তাহলে কি দুর্বৃত্তদের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সাহস হতো? যে বা যারাই আগুন লাগাক, এটা তো পরিষ্কার নাশকতা, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটানো। কারণ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টাও মূলত মৃত্যুর পথেই ঝাঁপ দেওয়া। রেললাইনের উচ্চতা, মাটি থেকে ট্রেনের উচ্চতা, লাইনের পাথর-সব মিলিয়ে বাঁচার সুযোগ কম। কিন্তু সৌভাগ্যবশত প্রাণহানির সংখ্যা বাড়েনি। আমরা যদি আগের কথা সরিয়েও রাখি, তা হলেও ২৮ অক্টোবর থেকে বাসে-ট্রেনে যেভাবে আগুন লাগানো হচ্ছে, তারই কী সুরাহা হয়েছে? প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, গত ৭১ দিনে ৩০৩টি নাশকতামূলক আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে লাগানো এ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে ৩০২টি যানবাহন। মারা গেছেন নয়জন। নাশকতার আগুনে শুধু বাস-ট্রেনই নয়, বাদ যায়নি ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুলিশবক্স, কাউন্সিলর অফিস, বিদ্যুৎ অফিস এবং বাসের কাউন্টারও।

রাজনৈতিক তাৎপর্য থেকে এগুলো আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সর্বনাশকেও উপেক্ষা করার উপায় নেই। প্রতিটি সহিংসতার পর সরকার এবং বিরোধী দল উভয়েই যেন মুখে কুলুপ আঁটে। আগুনে পুড়ে মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে তারা নিজেদের মতো করে বক্তৃতা-বিবৃতি আর পরস্পরে দোষারোপ জারি রাখে। কিন্তু এ মানবিক বিপর্যয় এড়াতে তাদের আগ্রহ আছে এমন ভূমিকা কতটুকু? অথচ এর সঙ্গে তো সাধারণ মানুষের স্বার্থই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে। আর সাধারণ মানুষ ছাড়া রাজনীতি কার জন্য? কাদের জন্য? তবে কি রাজনীতি হেরে যাচ্ছে? সমাজ তো আজ রাজনীতির দ্বারাই বিভক্ত ও চিহ্নিত। সে কারণেই কি আদর্শের বাইরে এসে শুধু ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার জন্যই এ লড়াই? অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রথম দায়িত্ব কার? এ রকম নানা প্রশ্ন আছে, থাকবেও। কিন্তু তাতে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের দায়ও লাঘব হয় না। তাদের কর্তব্য সহিংসতা ঘটলে রাজনৈতিক রঙ বিচার না করে ব্যবস্থা গ্রহণ। কিন্তু সেই সহজ কাজটিই যেন সহজে হচ্ছে না। অথচ সাধারণ মানুষকে এমন ‘সংখ্যা’ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সে কাজটি করা ভিন্ন উপায়ও নেই। যারা ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করেছে সেই কুশীলবদের খুঁজে বের করে পুরো ষড়যন্ত্র সামনে আনতে এত কেন দীর্ঘসূত্রতা? সন্ত্রাস ও নাশকতার ঘটনা তদন্তে ও দমনে যত দেরি হবে, তত এ ধরনের ঘটনা বাড়বে। আগের প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ ও সঠিক সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের সংখ্যা হয়ে যাওয়া থামানো যাবে না। আমাদের এও মনে রাখা বাঞ্ছনীয় মানুষ কোনোভাবেই শুধু প্রাণীমাত্র নয়।

ট্রেনের বগি কিংবা যানবাহনে আগুন লাগানো নিছক দুর্ঘটনা এমন বলার সুযোগ নেই। বরং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই যে একের পর এক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে সে বিষয়টিই যেন স্পষ্ট, তাই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। না হলে এভাবে একই পদ্ধতিতে বিভিন্ন জায়গায় কীভাবে আগুন লাগবে? ‘কীভাবে আগুন লাগল, তার তদন্ত শুরু হয়েছে’ এ রকম খবরও প্রতিটি ঘটনার পরই জানা যায়। অথচ সেই প্রতিবেদন আর প্রকাশ পায় না। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা তো এতটাও খেলো নয় যে, যেখানে সেখানে দিনে-রাতে বাসে-ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যাবে?

তাহলে কি আমরা রাজনৈতিক সর্বনাশে তলিয়ে যাচ্ছি? রাজনীতি হেরে যাচ্ছে? মানুষ হেরে যাচ্ছে? বিপরীতে জিতে যাচ্ছে সহিংসতা? রাজনৈতিক দলগুলো কি শুধুই ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার বাঘের পিঠে সওয়ার? তাই মানুষের স্বার্থের দিকে কারও নজর নেই! আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এ উপমহাদেশ আগেও দেখেছে। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে মানুষ অসহযোগ আন্দোলন করেছে। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। কিন্তু এসব আন্দোলনের কোনোটিই হিংসা ছড়ায়নি। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ক্ষমতার সিঁড়ি তৈরি করেনি। সাধারণ মানুষকে বলির পাঁঠা বানায়নি। ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার পট পরিবর্তনের জন্য মানুষ মরতে পারে না। অথচ কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বিপজ্জনক লক্ষণসহ এ ভয়াবহতাই উঁকি দিচ্ছে। সহিংসতা নতুন বিপদ হিসেবে মাথা তুলছে। এজন্য নিশ্চয় রাজনীতিকদের দায় আছে। তাদের এই দায় ভুলে যাওয়া অনুচিত। তাদের জবাবদিহি করতে হবে জনগণের কাছে। জনজীবন জিম্মি করে রাজনীতি করার অধিকার কারো নেই। সাধারণ মানুষের বলিষ্ঠ পদক্ষেপও এ ক্ষেত্রে জরুরি; যা যথার্থ অর্থে দায়হীন রাজনীতিকদের বোঝাতে পারে, তারা কারও ক্ষমতায় আসা-যাওয়ার সিঁড়ি নয়।

  • কবি ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা