স্মরণ
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:১৩ এএম
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে নানাভাবে দেখার
সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁর মতো একজন প্রাজ্ঞকে আমার পক্ষে বিশদভাবে চেনাজানা শেষ পর্যন্ত
সম্ভব হয়নি আমারই সীমাবদ্ধতার কারণে; অনেক ভাবেই তাঁকে কাছে পেয়ে কিংবা তাঁর স্নেহার্দ্র
হাত আমার মাথা স্পর্শ করে থাকা সত্ত্বেও। তাঁর কাজের সীমানা যেমন বিস্তৃত, খ্যাতির
সীমানাও সঙ্গত কারণেই ততোধিক বিস্তৃত। তাঁর জীবন অধ্যায়ের প্রায় অন্তিমে কবিতা তাঁকে
খুব ভর করেছিল। রবীন্দ্র গবেষণায় নিবিষ্ট ছিলেন এবং একই সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে
তুলে এনেছেন। তাঁর জীবনের প্রায় শেষ দিকে কৌতূহল যেন তাঁকে খুব তাড়া করত। স্যারের এ
কৌতূহলের কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে বহুবার ধমক খেয়েছি
এবং প্রতিবারই মনে হয়েছে এ যেন আশীর্বাদেরই বারিবর্ষণ। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধায়
বিনম্র চিত্তে তাঁকে স্মরণ করি।
কোরানশরিফ সরল
বঙ্গানুবাদ, যথাশব্দ, গঙ্গা ঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের তারিখ, বং বঙ্গ বাঙ্গালা
বাংলাদেশ, সরকার সংবিধান ও অধিকার, ১৩ই ভাদ্র শীতের জন্ম, কলম এখন নাগালের বাইরে, আমরা
যাবো না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে, মৌসুমী ভাবনা, মিত্রাক্ষর, সাবদেলের
মহড়া, দায়মুক্তি, উন্নত মম শির, যার যা ধর্ম, বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না, স্বাধীনতার
দায়ভার, বাংলাদেশের নানান ভাষা, স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন ইত্যাদি অনেক গ্রন্থই
তিনি রচনা করে গেছেন যা আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর উচ্চতর ডিগ্রির বিষয় ইতিহাস। ইতিহাসে তিনি শুধু পাঠই নেননি,
নিজেকেও কর্মোজ্জ্বল ইতিহাসের পরিধিতেও নিয়েছেন।
তাঁকে যদ্দুর
দেখেছি, মনে হয়েছে তিনি প্রতিবাদের সাহসের স্তম্ভ। আত্মাভিমান ছিল বটে কিন্তু ন্যায়পরায়ণতার
সব ক্ষেত্রেই ছিলেন বলিষ্ঠ ন্যায়দণ্ডধারী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক
হিসেবে যোগ দিয়েও পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যোগ দেন। একপর্যায়ে আইনজীবী হিসেবে
পেশা গ্রহণ করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে হাইকোর্টের বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে
নিয়োগ এবং বিচার বিভাগে শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে
আমাদের রাজনৈতিক বাঁক পরিবর্তনের ইতিহাসে রাষ্ট্র ও রাজনীতি যখন পড়ে যায় বলতে গেলে
গভীর খাদে, তখন ত্রাতা হিসেবে তিনি তৎকালীন সরকারব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান
উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাঁর জীবন
অধ্যায়ে অভিনব প্রতিবাদের ভাষা ছিল ছাত্রাবস্থায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর ছিল
সক্রিয় অংশগ্রহণ। অভিনব প্রতিবাদ হিসেবে বিড়ি-সিগারেট বিক্রির একটি বাক্স গলায় ঝুলিয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরতে শুরু করলেন তার ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত হয়ে।
ওই বাক্সের গায়ে লেখা ছিল, ‘মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এমএ (প্রথম শ্রেণি)’। তাঁর এ অভিনব
প্রতিবাদে যাদের লজ্জিত হওয়ার কথা তারা লজ্জায় মাথা নুইয়েছিলেন; যদিও আজকের বাস্তবতায়
অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জা বিসর্জিত। তাঁর ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি রচনাগুলোয় বাঙালি ও বাংলাদেশের
প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার সাক্ষ্য দেয়। তাঁর জীবন ও কাজ আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের
চেতনাবোধ ও অস্তিত্বের নোঙর শক্তিশালী করতে অধিকতর প্রেরণা জুগিয়ে চলবেই, এ আর বলার
অপেক্ষা রাখে না। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকের মতো অনেক মূল্যবান অর্জনই তাঁর
ঝুলিতে আছে। এর চেয়েও তাঁর বড় অর্জন মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। স্যারকে প্রণতি।