সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:১৯ এএম
চাল নিয়ে চালবাজি
থামছেই না। ‘ভরা মৌসুমে ভালো ফলনেও কেন বাড়ল চালের দাম’ শিরোনামে ১২ জানুয়ারি প্রতিদিনের
বাংলাদেশে ফের চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে উঠে এসেছে বাজার বা ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি
সম্পর্কে আমাদের সমাজে বহুল কথিত শব্দ সেই ‘সিন্ডিকেট’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন
পর্যন্ত ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ প্রায় ৯৮ ভাগ শেষ এবং তাতেই চাহিদার কাছাকাছি পৌঁছে
গেছে উৎপাদন। প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, জমিতে থাকা বাকি ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হলে
উৎপাদনে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। তা ছাড়া মজুদ এবং সরবরাহব্যবস্থায় নেই কোনো সংকট।
তারপরও পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়েই চালের দাম কেজিতে চার থেকে দশ টাকা বেড়ে যাওয়ার
বিষয়টি বিস্ময়কর। ওই প্রতিবেদনেই জানা গেছে, শুধু চালই নয়, পাশাপাশি বেড়ে গেছে আটা,
ছোলাসহ আরও কিছু নিত্যপণ্যের দাম।
চাল আমাদের প্রধান
খাদ্যশস্য। আমাদের সমাজে ‘মোটা ভাত, মোটা কাপড়’ এই প্রবাদটি বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমরা
দেখছি, মোটা ভাত কিংবা মোটা কাপড় এই দুই-ই মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষে জোগাড়
করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি, সাধারণত পবিত্র রমজানে ছোলার চাহিদা বাড়ে কিন্তু
এবার দেখা যাচ্ছে, রমজানের অনেক আগেই এই পণ্যটির দাম ইতোমধ্যে দুই দফা বেড়ে গেছে। চালের
আরেক দফা দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আড়তদার-মজুদদার এমনকি খুচরা ব্যবসায়ীদের আবারও সেই
খোঁড়া যুক্তি। আমরা দেখছি, চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে বরাবরই মিলারদের কারসাজি পরিলক্ষিত
হয়। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ৫০ কেজি চালের বস্তাপ্রতি তারা হুট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন
২৫০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ৩০০ টাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সিংহভাগ মানুষ মোটা চাল
কিনে থাকেন এবং যারা মোটা চাল কেনেন তারা সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের পক্ষে এক
লাফে কেজিতে চালের দাম ১০ টাকা বেড়ে যাওয়ার তাপ-চাপ সহ্য করা কঠিন। দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক
ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অনেক নিত্যপণ্যের দাম সিংহভাগ ভোক্তার ক্রয়সাধ্যের বাইরে
রয়েছে। তারা তাদের নিত্য চাহিদায় কাটছাঁট করেও জীবনযাপন স্বাভাবিক রাখতে কঠিন পরিস্থিতির
মুখে পড়েছেন।
আমরা দেখেছি- বিগত
সরকারের বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীই বাজারের সিন্ডিকেটের
কারসাজির কথা অকপটে স্বীকার করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট নিয়ে তাদের বক্তব্য
যেন ওই স্বেচ্ছাচারী-লুটেরাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মতো মনে হয়েছে। এই সম্পাদকীয়
স্তম্ভেই আমরা বহুবার বলেছি, সিন্ডিকেটের হোতাদের হাত কোনোভাবেই আইনের হাতের চেয়ে শক্তিশালী
হতে পারে না। আমরা এই প্রশ্নও বহুবার উত্থাপন করেছি, সিন্ডিকেটের শিকড় কি এতই গভীরে
প্রথিত যে, এর মূল উৎপাটন করা যায় না? চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এখন আর কোনো নির্দিষ্ট
শ্রেণি নয়, বলতে গেলে সব শ্রেণির মানুষেরই দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। কী কারণে চালের বাজার
আবার হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল এ প্রশ্নের জবাব কর্তৃপক্ষের যেমন খুঁজতে হবে তেমনি অনতিবিলম্বে
চালের দাম নিয়ন্ত্রণেও কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা বাজারে তদারকি-নজরদারি
বাড়ানোর তাগিদও ইতোমধ্যে বহুবার এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই দিয়েছি। কিন্তু বাজারের অস্থিতিশীলতা
কেন থামানো যাচ্ছে না, এ যেন অন্তহীন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অসহনীয় পরিস্থিতি কোনোভাবেই
চলতে পারে না।
ইতোমধ্যে নবনির্বাচিত সরকার তাদের শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করেছে। আমরা মনে করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বাজারে সিন্ডিকেটের দাপাদাপি থামিয়ে যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নির্মোহ অবস্থান নিতেই হবে। নতুন সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম মূল্যস্ফীতির কষাঘাত যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রতি কোনোরকম অনুকম্পা দেখানো যাবে না। টানা চতুর্থবারের মতো এই সরকারের সাফল্যের খতিয়ান কম বিস্তৃত নয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি-অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাফল্য দৃশ্যমান করতে পারেনি নানা মহলের এই অভিযোগ এড়ানো কঠিন। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল করতে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করাও জরুরি। একই সঙ্গে টিসিবির ট্রাকসেল, ডিলারদের মাধ্যমে চালসহ যেসব ভোগ্যপণ্য বিক্রয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে এর পরিসরও বাড়াতে হবে। আমরা মনে করি, সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে স্বেচ্ছাচারীদের আস্ফালন বন্ধ করা মোটেও দুরূহ কোনো বিষয় নয়। চালসহ নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ফেরানোর দায় অবশ্যই সরকারের।