× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়ন

সময় এখন কৌশলী ভাবনায় ‘টিকটক ডিপ্লোম্যাসি’

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৮ পিএম

সময় এখন কৌশলী ভাবনায় ‘টিকটক ডিপ্লোম্যাসি’

১৮ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিংয়ের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭ জানুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠককালে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। একই দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ইইউ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কোনো একটি পক্ষ হয়তো বিদেশিদের বুঝিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা বা নানাবিধ আন্তর্জাতিক চাপের ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে দেশের গণতন্ত্র সুসংহত হবে। এরই ভিত্তিতে নির্বাচনের আগে বিদেশিরা নানা সময়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর তারা বুঝতে পেরেছেন তাদের পন্থাটি সঠিক ছিল না। বিদেশি পক্ষরা এও হয়তো বুঝতে পেরেছেন, যে পক্ষগুলো সক্রিয়ভাবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্থিতিশীলতার বিষয়ে বিদেশিদের অবহিত করছিল তারা হয়তো দেশের গণতন্ত্র সুসংহত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে না। বরং তাদের ইন্ধনের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে কোনো কোনো মহল সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই রাশিয়া, চীনও আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করে। একসময় ভারতও এ বিষয়ে তার স্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়। ভারত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার পর রাশিয়া ও চীনও তাদের অবস্থান বদলে ফেলে। এমনিতে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই বলে রাশিয়া ও চীনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। কিন্তু ভারত যখন আমাদের নির্বাচন প্রসঙ্গে মন্তব্য করে তখন আর তর্কের অবকাশ থাকে না। পশ্চিমা দুনিয়াও বুঝতে পারে, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে তারা যে পলিসি তৈরি করেছিল তা হয়তো ঠিক নয়। পৃথিবী একটি বহুমাত্রিক কাঠামোর দিকে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। বহুমাত্রিক বিশ্বে সব ধরনের প্রতিযোগিতাই হবে তীব্র। পশ্চিমা দুনিয়া জানে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বড় অংশীদারত্ব আছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের এই বড় অংশীদারত্বে সামান্য অবনতি ঘটলে অন্যান্য শক্তি যারা রয়েছে তারা সুযোগ পেয়ে যাবে। এই শক্তিগুলো যাতে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবনতির সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্য তারা সতর্ক থাকবেÑএমনটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমা দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার সতর্কীকরণে ব্যবসায়ীরাও তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেন। বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার প্রসারের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে শুরু করেন। আমদানির কথা বিবেচনা করে পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য এটি ভালো কিছু নয়। তারাও দ্রুতই বুঝতে পেরেছেন নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে, যা সরাসরি বাণিজ্য খাতের সামনে নানা প্রতিবন্ধক গড়ে তুলবে। একই কথা দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ একাধিক প্রসঙ্গের বিষয় টেনে এনে তারা এমন মন্তব্য করেছিলেন। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে নেননি। তারা অন্যান্য দেশের বাজারে খোঁজ নিতে শুরু করেন। কীভাবে নিজেদের ব্যবসা অন্য দেশের বাজারে পরিচালনা করা যায়, তা নিয়ে তাদের ভাবতেই হয়। এক্ষেত্রে সফলতাও যে মিলেনি তা নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে। জাপানের বাজারে লেনদেন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে ভারত ও চীনের বাজারেও আমাদের বাণিজ্য বাড়তে শুরু করেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংকটকালেও বৈচিত্র্য দেখা গেছে। এই বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করে পশ্চিমা দুনিয়া অনুধাবন করেছে, তাদের স্বার্থ নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর গণতন্ত্র প্রসঙ্গে তাদের যে অভিযোগ ছিল তা দূর হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ বলতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকট-সমস্যার সমাধান জনগণকেই করতে হবে। দেশের মানুষই যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যার সমাধানে সক্ষম তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। কোনো কোনো মহল প্রত্যাশা করেছিল, বিদেশিরা চাপ দিলে দেশের গণতন্ত্রের ঘাটতি দূর হবে, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

গণতন্ত্রের অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের নানা কর্মসূচি রয়েছে। এ বিষয়ে গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা তৎপরতা দেখিয়ে থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমনকি কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের অবস্থান এই ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষয়সাধন করেছে। একটি অঞ্চলে গণহত্যা চলছে অথচ পশ্চিমা দুনিয়া মৌনব্রত পালন করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশ ভালোমতোই জানে, ইসরায়েলের সহযোগী হিসেবে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক বৈশ্বিক শক্তি। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে এটি বাংলাদেশের অবস্থানের বড় পরিচায়ক। পশ্চিমা দুনিয়াও বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের অংশের গণতন্ত্র প্রসঙ্গে যে ভাবনা রয়েছে তা দিয়ে সম্পর্কোন্নয়ন করা যাবে না। এমনকি এ দেশের মানুষও গণতন্ত্রের এই ভাবনার সঙ্গে একমত পোষণ করবে না। তাই তারা পরিকল্পনায় রদবদল এনেছেন। নীতিপর্যায়ে রদবদল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত করতে পারে। অতীতেও আমরা আফগানিস্তানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন রদবদল তাদের মধ্যে দেখেছি। এ রকম অনেকগুলো কারণ বিবেচনা করেই তারা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমা দুনিয়াও বুঝতে পেরেছে, আমাদের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক রাখা দরকার।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বহু আগে থেকেই বলে আসছি, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে পশ্চিমা দুনিয়ার সুর পাল্টে যাবে। যে একাডেমিক অঙ্গনে আমি শিক্ষকতা করি, সেই অঙ্গনের বদৌলতে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। বিশেষত কূটনীতি পর্যায়ের অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপকালে তাদের ভাবনা সরাসরি জানার সুযোগ হয়। তাই আমার এই বক্তব্যটি ছিল পর্যবেক্ষণ ও যাচাইসাপেক্ষ। দেশে রাজনৈতিক সংকট এখনও জিইয়ে আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচনে তাদের অংশ না নেওয়ার কারণগুলো জটিল। শুধু গণতন্ত্রের স্বার্থে দলটি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, এমনটি বলা যাবে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে সংলাপ আয়োজনের সুযোগ দেখা না গেলেও কূটনীতিক বা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে প্রায়শই আলোচনার সুযোগ থাকে। বিশেষত একাডেমিয়ায় সেমিনার বা আলোচনা সভার কাজটি এখন সহজ। জনসম্মুখে কূটনীতিক কিংবা নীতিনির্ধারকরা যখন কথা বলেন, তখন সংযত থেকে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুখোমুখি বৈঠকে তারা কিছুটা খোলাখুলিভাবে কথা বলেন। ফলে তাদের প্রবণতা কেমন হতে পারে তা বোঝা আমাদের জন্য কিছুটা সহজ। পশ্চিমা দুনিয়ার সুরবদলের বিষয়ে আমার অনুমানটিও বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই।

রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কিছু ঘাটতিও বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। সময় এসেছে পেশাদারত্ব বাড়ানোর। আমাদের তথ্য সংগ্রহ, ইন্টেলিজেন্সসহ কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা জরুরি। বিদেশিরা যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করতে না পারে, সে বিষয়েও কূটনৈতিক পেশাদারত্বের পরিচয় দিতে হবে। সর্বোপরি আমাদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক করার বিষয়ে কাজ করতে হবে। কারণ আমাদের বৈদেশিক ভাবমূর্তি খুব ভালো নয়। দেশের অভ্যন্তরে এমনকি দেশের বাইরে কয়েকটি মহল দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য সক্রিয়। ভাবমূর্তি ইতিবাচক করতে হলে আমাদের তথ্য সংগ্রহ করার পদক্ষেপ বাড়াতে হবে। তথ্য-প্রমাণনির্ভর তথ্য দিতে পারলে বিদেশিদের আস্থা ফিরে আসবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের উচিত লিখিত তথ্যনির্ভরতার সঙ্গে ভিজ্যুয়াল তথ্যও বাড়ানো। এজন্য শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই নয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেই পর্যাপ্ত তথ্য সংযুক্ত করতে হবে। তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে টিকটকের যেমন এখন জুড়ি মেলা ভার, তেমনি আমাদেরও ‘টিকটক ডিপ্লোম্যাসি’তে ঢুকতে হবে। জনগণকে যেন তথ্যের খোঁজে যেতে না হয়। তথ্য মানুষের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে কাঠামো ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা আরও স্পষ্ট প্রতিভাত হবে। একইসঙ্গে আমাদের বন্ধু ও উন্নয়নসহযোগী দেশগুলোর মনোভাব প্রকাশও সহজ হবে। 


  • কূটনীতি ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা