প্রজন্মের ভাবনা
বাঁধন বৈষ্ণব
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:২৯ পিএম
প্রযুক্তি আমাদের
জীবনে এনেছে গতি। যান্ত্রিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যস্ততা আমাদের সবার। জন গ্রিন তার ইন্ট্রোডাকশন
টু পপুলার কালচার গ্রন্থে বলেছেন, ‘আগে জীবনযাপনের নিরিখে কাজ করলেও এখন আমরা জীবনযাপন
করতে কাজ করি।’ আধুনিকতার ডামাডোলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য
আর প্রথা। অতীতে একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থার সুখ নিয়ে অনেকের নানা স্মৃতি রয়েছে।
তারা আজ প্রবীণ বা বৃদ্ধ। আবার অনেকের শৈশবে রাতের ঘুম এসেছে রূপকথার গল্পের আদলে।
নানি/দাদির কোলে মাথা রেখে রূপকথার গল্প শোনেনি এমন মানুষ এক দশক আগেও খুঁজে পাওয়া
কঠিন ছিল। তবে প্রযুক্তি গল্প শোনার সেই প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন ফুরিয়েছে
খেলাধুলার। আগে দলবেঁধে অথবা দুজন বন্ধু মিলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলে সময় কাটিয়ে দেওয়া
যেত। এখন সে সময় কাটে মোবাইলে চ্যাটিং করে।
শৈশব অনেকের কাছে
স্মৃতি, আজকের প্রজন্মের কাছে হয়তো তা লুপ্ত সংস্কৃতি। আমাদের মাঝের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোও
শিথিল হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন আর সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বিনোদনের উৎসগুলো হয়ে
গেছে যান্ত্রিক। একটু আয়েশ আর সুখ লাভের প্রত্যাশায় আমরা ছুটে চলেছি হন্যে হয়ে। পরিবারের
কারোরই সময় নেই। সবাই তো মোবাইল ফোনেই সংযুক্ত। পারিবারিক আড্ডা, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া
কিংবা একটু সংযোগের সুযোগটুকু কেউ নিতে রাজি নয়। দেশে তরুণ প্রজন্মের আজ বিনোদনের
অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইউটিউবসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া।
প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ফেসবুক, টুইটার ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রলিং করা হয়ে গেছে আমাদের নিত্যদিনকার
কর্ম। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে পাঠাভ্যাসের সঙ্গে। অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে তরুণ
সমাজের উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ব্যস্তময় এই জীবনে পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী
আর প্রিয় মানুষগুলো থেকে দূরীভূত হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক আর মিথস্ক্রিয়া।
বাড়ছে বেকারত্ব,
একক পরিবার, বৃদ্ধাশ্রম আর অনাথ আশ্রমের সংখ্যা। ব্যাহত হচ্ছে এখনকার শিশুর যথাযথ সামাজিকীকরণ।
কর্মব্যস্ত যুগে একজন মা কিংবা বাবা যখন তার সন্তানকে যথাযথ সময় দিতে ব্যর্থ হয়, তখন
ব্যাহত হয় ওই শিশুটির যথাযথ সামাজিকীকরণ, শিষ্টাচার আর মানবিকতার শিক্ষা। পারিবারিক
যথাযথ স্নেহ থেকে বঞ্চিত শিশুর মাঝে তখন বিপথগামী হওয়ার মনোভাব তৈরি হতে থাকে। ফলে
নেমে আসে কিশোর অপরাধ আর মাদকাসক্ত হওয়ার মতো অভিশাপগুলো।
প্রযুক্তির উন্নয়ন
নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু প্রযুক্তির অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার
ধ্বংস করছে আমাদের সৃজনী ক্ষমতা। বাস্তব জীবনে আমাদের প্রকৃত বন্ধুবান্ধবের চেয়ে দিনে
দিনে বাড়ছে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব। তাই মননশীল জাতি, মাদকমুক্ত সমাজ মানবিক মূল্যবোধে
অনুপ্রাণিত দেশ বিনির্মাণে আমাদের প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। পরিবার,
প্রতিবেশী আর সমাজের প্রত্যেকের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া আর সৌহার্দ্যপূর্ণ
আচরণ তৈরি করতে হবে। শিশুর যথাযথ সামাজিকীকরণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে
হবে। একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত
করানোর উদ্যোগ নিতে হবে।