অপচিকিৎসা
মামুন রশীদ
চলতি পথে, হঠাৎ
কোথাও বিকট আওয়াজে আতঙ্কিত মানুষ প্রথমে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য
হয়ে সটকে পড়ার চেষ্টা করে। ধাতস্থ হলে ফিরে আসে শব্দের উৎসের কাছে, জানার চেষ্টা করে
কোথায়, ঠিক কী ঘটেছে? কয়েক বছর আগে করোনাভাইরাস তেমনি আমাদের আতঙ্কিত মানুষের মতো পথ
থেকে হটিয়ে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে মানুষ ধাতস্থ হয়েছে এবং বলা যায়, সম্বিত ফিরেছে। কিন্তু
সত্যিই কি আমাদের সম্বিত ফিরেছে? করোনায় স্বাস্থ্য খাতের যে দুর্বল দিকগুলো উন্মোচিত
হয়েছিল, তা কি মেরামত হয়েছে? ভবিষ্যৎ যেন শঙ্কামুক্ত থাকে, মানুষ যেন নিরাপদ থাকে আমরা
কি সেদিকে নজর দিয়েছি?
গত কয়েক দশকে
দেশজুড়ে ঝাঁ-চকচকে হাসপাতাল ভবন নির্মাণ হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের
সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে শানশওকতও। কিন্তু সেবার ঔজ্জ্বল্য কি বেড়েছে? অবকাঠামোগত উন্নয়ন-অগ্রগতির
সঙ্গে চিকিৎসাসেবার উন্নতিও কি নিশ্চিত হয়েছে? করোনায় নিয়ন্ত্রিত জীবনের যে শিক্ষা
পেয়েছি, তা-কি আমরা কাজে লাগিয়েছি? মোটা দাগে এর উত্তর হয়তো একটি বড়সড় ‘না’। আর প্রশ্নগুলোর
উত্তর অনেকাংশে ‘না’ বলেই মাত্র কয়েক দিন আগে খতনা করাতে গিয়ে মারা গেল শিশু আয়ান।
সন্তানের মৃত্যুর পর তার বাবা সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘নামিদামি অনেকেই ইউনাইটেড
মেডিকেলে স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সেজন্য কিছু টাকা বেশি গেলেও ছেলেটার খতনা নিরাপদে হবে
এ বিশ্বাস থেকেই ওখানে গিয়েছিলাম। অথচ ছেলেটা আমার লাশ হয়ে ফিরল!’ আয়ানকে গত বছরের
৩১ ডিসেম্বর নেওয়া হয়েছিল রাজধানীর সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
সেখানে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি সাড়ে পাঁচ বছরের শিশুটির। তার বাবার
অভিযোগ, ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতালের অবহেলার কারণেই আয়ানের অকালমৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার
রেশ মিলতে না মিলতেই আরও একটি খবরে চোখ আটকে যায়। শিউরে ওঠে সব অনুভূতিই। রংপুরে বিল
দিতে ব্যর্থ হওয়ার অজুহাতে ৪০ হাজার টাকায় জোরপূর্বক নবজাতক বিক্রির ঘটনা ঘটে হলি ক্রিসেন্ট
হাসপাতালে।
তবে আশার কথা,
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুটি ক্ষেত্রেই দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা শিশু আয়ানের মৃত্যুর
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরই ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম
বন্ধের নির্দেশ দেয়। হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যথাযথ নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম
পরিচালনা করছিল। সংবাদমাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ‘এ নামে
কখনও কোনো নিবন্ধনের আবেদনও করা হয়নি।’ হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে,
কিন্তু অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। রংপুরের
হাসপাতালটিও অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। ঘটনা জানাজানির পরই স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের তরফে ২২ জানুয়ারি এ হাসপাতালটিও সিলগালা করে দেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যমকে জেলা
সিভিল সার্জন জানান, হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স ছিল না। অবৈধভাবে চলছিল। সকালে
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে হাসপাতালটি বন্ধসহ সিলগালা করে দেন। তবে এখানেও
হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা জানা গেলেও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা
জানা যায়নি।
মানুষ হাসপাতাল
বা ক্লিনিক-নার্সিংহোমে চিকিৎসা-গাফিলতি বা ভুল চিকিৎসার শিকার তো হামেশাই হচ্ছে। বিতর্ক
রয়েছে চিকিৎসকের দায়িত্ব নিয়েও। রোগীকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যাওয়া চিকিৎসকের প্রধান কর্তব্য,
যা চিকিৎসকের ধর্ম। অথচ সেই সত্যও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। চিকিৎসকের প্রতিও টলে উঠছে
সাধারণের বিশ্বাস। দীর্ঘ হচ্ছে চিকিৎসকের প্রতি আস্থাহীনতার ছায়াও। সঙ্গে রয়েছে ভুয়া
চিকিৎসকের দৌরাত্ম্যও। তাই হয়তো এখন শুধু উচ্চবিত্তই নয়, নিম্নমধ্যবিত্তও আশপাশের দেশে
ছুটে যাচ্ছেন চিকিৎসাসেবা নিতে।
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারে দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দেশে
আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় যুগান্তকারী অবদান রাখা চিকিৎসক ডা. সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে চান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চিকিৎসক হিসেবে তার পেশাগত জীবনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। নিজের
অভিজ্ঞতাতেই তিনি জানেন স্বাস্থ্য খাতের কোথায় কী সমস্যা রয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে তাই বলেছেন,
‘আমার একটা স্বপ্ন, আমি চেষ্টা করব স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার,
সিনসিয়ারলি, অনেস্টলি।’ আমরা সে বিষয়টিই দেখতে চাই। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য
আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনস্বাস্থ্য। এতে শুধু রাজধানীই নয়,
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অবকাঠামো মজবুত করা এবং চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি।
অথচ সে কাজটিই সম্ভবত দূরদর্শিতার সঙ্গে করা হয় না। প্রায়ই শোনা যায় হাসপাতাল আছে তো
চিকিৎসক নেই, চিকিৎসক আছেন তো বসার জায়গা নেই। রোগী আছেন, সেবা নেই। এক্স-রে মেশিনসহ
দামি মেশিনারিজ আছে, তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। এসব খবর পাঠ করে আঁতকে উঠতে হয়।
তাই নিবন্ধনবিহীন হাসপাতাল বন্ধ করা যেমন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তেমনি আমাদের বেসরকারি
স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি কড়া নজর দেওয়া জরুরি।
হরহামেশাই রোগী
ও রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসায় গাফিলতি নিয়ে এবং অকারণ টেস্টের নামে খরচ বাড়িয়ে
দেওয়া প্রসঙ্গে। রোগী বা রোগীর স্বজনের এমন অভিযোগের কারণ, তাদের ধারণা। কিন্তু সে
ধারণা সত্য কিনা এই অন্তোষও দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে এসব বিষয় মনিটরিংয়ের
জন্য কমিশনের ব্যবস্থা করা। কারণ চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের
অসন্তোষ দূর না হলে চিকিৎসাসেবার মূল লক্ষ্যই অধরা থেকে যাবে।
অণুজীব কোভিড-১৯ ভীতি আমাদের আতঙ্কিত করলেও শিখিয়েছিল অনেক। সেই শিক্ষা মনে রেখেই সভ্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দুর্বলতাগুলোর নিরসন জরুরি। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেদিকেই দৃষ্টিপাত করার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন, তাতে আশাবাদী হতে চাই। যেখানে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ফলানোর চেয়ে, অন্যকে ঘায়েল করার চেয়ে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার মনোযোগ হবে ত্যাগের দিকে, সেবার দিকে।