স্মরণ
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০১ এএম
ওয়াহিদুল হক
এ ভূখণ্ডের সাংবাদিকতা
ও সাংস্কৃতিক জগতের বটবৃক্ষসম আবুল ফাতাহ মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক প্রজন্মের কাছে চিরপ্রণম্য,
চিরস্মরণীয়। তার দীর্ঘ নামটি ছেটে দিয়ে তিনি ওয়াহিদুল হক নামেই পরিচিত ও ব্যাপ্ত, যিনি
নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হককে নানা
বিশেষণেই বিশেষায়িত করা যায়। কারণ তার ব্যাপৃত কর্ম অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে তিনি এ ছাপই
রেখে গেছেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতায়। ষাটের দশকে দি
অবজারভারের শিফট ইনচার্জ থেকে ক্রমান্বয়ে মর্নিং নিউজ ও ডেইলি স্টারের যুগ্মসম্পাদক
হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একসময় দ্য পিপলস পত্রিকার সম্পাদকের গুরুভারও তার ওপর বর্তেছিল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে এক দশকের বেশি সময় খণ্ডকালীন
শিক্ষক হিসেবেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে ওয়াহিদুল হকের মতো প্রাজ্ঞজনকে নিয়ে
লেখা সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর ফোঁটা বই কিছু নয়। ওয়াহিদুল হকের পাণ্ডিত্যের গভীরতা প্রজন্মের
কাছে অকূল সাগরের মতো। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অকূল সাগর-মাঝে চলেছে ভাসিয়া, জীবনতরণী’।
ওয়াহিদুল হক আমাদের কাছে তা-ই। পেশায় সাংবাদিক হলেও দাপুটে পদচারণ ছিল তার সংস্কৃতি
অঙ্গনে। মেধাবী সাংবাদিক, রবীন্দ্রসংগীতের তত্ত্বজ্ঞ, বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ প্রচারক
ওয়াহিদুল হকের হৃদয়জুড়ে ছিল বাঙালিত্বের চেতনার আলো। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত ‘স্বাধীন
বাংলা শিল্পী সংস্থা’ সংগঠনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ওয়াহিদুল হক একজন বীর কণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা।
জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত
সম্মিলন পরিষদ, আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলন, শিশু আবৃত্তি সংগঠন শিশুতীর্থ, কিশোর সংগঠন
মুকুলফৌজ, বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতি, বিজ্ঞান-সংস্কৃতি পরিষদ, নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়,
আর এ ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক জাগরণের নতুন মাত্রা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান ছায়ানটসহ কত কিছুর
সঙ্গে তার নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা এবং যত দিন সচল ছিলেন তত দিন এসবের মধ্যেই নিজেকে বিলিয়ে
দেওয়ার কি প্রাণান্ত প্রয়াস ছিল তার। ওয়াহিদুল হকের জীবনের আলো ছড়াতে শুরু করে শিক্ষাজীবনেই।
সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক পর্ব শেষ করে তিনি গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি মনোনিবেশ করেন
জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখায়। তার ‘অভয় বাজে হৃদয় মাঝে’ ও ‘এখনও গেল না আঁধার’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম
পাঠক-মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। আমার সৌভাগ্য, কর্মসূত্রে এই প্রাজ্ঞজনের স্নেহধন্য
হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। আমি তখন ‘ভোরের কাগজ’-এ। ‘এখনও গেল না আঁধার’ কলামটি ভোরের কাগজে
ছাপা হতো সম্ভবত বুধবারে। ভোরের কাগজে সম্পাদকীয় বিভাগে মঙ্গলবার অপরাহ্নে আমাদের কক্ষে
বসেই কখনও কখনও তিনি ‘এখনও গেল না আঁধার’ লিখতেন। তখন তাকে আরও নিবিড়ভাবে দেখার-পড়ার
সুযোগ পাই। ওয়াহিদুল হক কত ফর্মার বিশাল গ্রন্থ তখন তা জেনে বারবার পড়ার চেষ্টা করেছি,
কিন্তু ওয়াহিদুল হককে পাঠ করা তো এত সহজ নয়। সাহিত্যের বাচিকচর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠায়
‘কণ্ঠশীলন’-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আর
ছায়ানট, আলোকিত এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি কীভাবে পুষ্ট করেছেন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও
নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
চেতনাধারায় এসো,
গানের ভিতর দিয়ে, সংস্কৃতিই জাগরণের প্রথম সূর্য, সংস্কৃতির ভুবন তার এ অমূল্য গ্রন্থগুলোর
পাশাপাশি তারই সম্পাদিত আবৃত্তি ও গানের সিডি সকল কাঁটা ধন্য করে, আজ যেমন করে গাইছে
আকাশ, আছ অন্তরে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা—এসবই আমাদের কাছে দুর্লভ সম্পদ। সংগীতে বিশেষ অবদানের
স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে তাকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। বাংলা একাডেমির
সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জনের পাশাপাশি লাভ করেন স্বাধীনতা পুরস্কারও। তা ছাড়া আরও কত
সম্মাননা-পুরস্কার তার ঝুলিতে রয়েছে এর হিসাব নাই বা করলাম।
আবারও বলি, ওয়াহিদুল হকের মতো একজন ব্যক্তিত্বশালীকে, প্রতিষ্ঠানসম এই মানুষকে নিয়ে অল্প পরিসরে কিছু লেখা মানে তাকে মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত করা। তবু গভীর শ্রদ্ধাভরে তার প্রয়াণদিবসে এই স্মরণাঞ্জলি। কত কিছুতেই তো তিনি যুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে কণ্ঠশীলন, ছায়ানট, নালন্দাÑএ ক্ষেত্রগুলোয় তিনি আরও ব্যাপকভাবে ব্যাপ্ত। ওয়াহিদুল হককে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সাধ্য নেই, তাকে শুধুই প্রণতি।