× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ

সীমান্ত ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সতর্ক নজরদারি জরুরি

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:২০ পিএম

সীমান্ত ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সতর্ক নজরদারি জরুরি

২৯ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কী হচ্ছে এ সম্পর্কে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের স্পষ্ট ধারণা নেই। এর পরের দুই দিনও প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ অন্য সংবাদমাধ্যমে একই চিত্র উঠে এসেছে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও জটিল পরিস্থিতির চিত্রই মিলেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যখনই খারাপ থেকে খারাপের দিকে গেছে, তখনই আমাদের উৎকণ্ঠা সঙ্গত কারণে বেড়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব আমাদের জন্য যে স্বস্তির বার্তা নয়, এর নজির তো অদৃশ্যমান নয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরে সংঘাত ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠছে। থেমে থেমে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসছে। মর্টার শেল ও বুলেট এসে আঘাত করছে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। ফলে সীমান্তবাসীর মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উত্তরোত্তর বাড়ছে। মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সঙ্গে দেশটির বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাত-সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অসন্তোষ বাড়ছে সেনাবাহিনীর ভেতরেও। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের এখানে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার তাগিদ আসছে নানা মহল থেকে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা বলে বাস্তবে কিছু নেই। এদিকে মিয়ানমারে ভারী অস্ত্রের ব্যবহার ও উলুবনিয়া সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে বেশ কয়েকবার হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা যাওয়ার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার বিষয়টি ফের নতুন করে আমাদের সামনে এসেছে।

জান্তা সরকার রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সামরিক কৌশলগত কারণে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং পরিস্থিতি তদারকির জন্য হেলিকপ্টার দিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় টহল দিচ্ছে। যেহেতু বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা গ্রামীণ এলাকায় কিংবা সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আত্মগোপন করছে তাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সময় আক্রমণ চালাচ্ছে। সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ঢল আবার বাংলাদেশে আসবে কি না, এ নিয়েও নানা মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এ আশঙ্কা অবশ্য ক্ষীণ। আমরা জানি, মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে। আবার কিছু অঞ্চল এখনও জান্তা সরকারের অধীনে রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের মানুষ আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম না করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী মিয়ানমারে শুধু রাখাইন অঞ্চলেই সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি বিদ্যমান এমনটি নয়। গোটা মিয়ানমারের পরিবেশই উত্তপ্ত। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী যুদ্ধ করছে। ৩০ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনের মিনবিয়া শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। অর্থাৎ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গৃহদাহ চরম আকার ধারণ করেছে। সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিজয়ের ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার সক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে জান্তা সরকার এ যুদ্ধ কত দিন চালিয়ে যেতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য ইতোমধ্যে পক্ষ ত্যাগ করছে বা পালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী থেকে সেনা সদস্য পালিয়ে যাওয়ার ফলে জান্তা সরকার নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া শুরু করা কঠিন বইকি। তার পরও জান্তা সরকার সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছে। এটি ভুল বলে মনে করি। বরং তাদের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা উচিত।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জান্তা সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে দীর্ঘদিন, বলতে গেলে লাগাতার। বিগত কয়েক বছরে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরও তাদের নিপীড়ন বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশটির অখণ্ডতা বজায় রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেই রাজনৈতিক সমাধান মিলবে না। বরং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক চ্যানেলকে তৎপর হতে হবে। মিয়ানমারে যদি রাজনৈতিক সমাধানের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তাহলে রোহিঙ্গারা যেন বাদ না পড়ে এজন্য আন্তর্জাতিক মহলে নিবিড় যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমরা জানি, মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত গণহত্যার বিচারকার্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলমান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল করতে হলে এ বিচারকার্য যেন চলমান থাকে সেজন্যও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এ মুহূর্তে প্রয়োজন বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি। ধারণা করা হচ্ছিল, মিয়ানমারের ওপর পরাশক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এখন এ ধারণা কিছুটা ভুল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চীনা গোয়েন্দা নজরদারি বেড়েছে। চীন-মিয়ানমার সীমান্তে চীনের কঠোর নজরদারি রয়েছে। এমনকি চীনা গুপ্তচররা মিয়ানমারের ভেতর ঘাঁটি গেড়ে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি। সর্বোপরি, শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করাই মূল চ্যালেঞ্জ।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শঙ্কার বড় কারণ নেই বলে মনে করি। তার পরও কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়ে যায়। চলমান যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের জঙ্গলাকীর্ণ কিংবা পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করতে পারে। তাতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা সংকট বাড়তে পারে। তাই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করা জরুরি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অহেতুক চলাচল বা গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সীমান্ত এলাকা দিয়ে নতুন কারও অনুপ্রবেশ ঠেকানোর প্রস্তুতি রাখতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা বিভিন্ন সময় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের জঙ্গলাকীর্ণ কিংবা পার্বত্য এলাকায় এসে ঠাঁই গড়ে নিতে পারে। তা ছাড়া রাখাইন অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ঢলও এখানে আসতে পারে। এ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। সীমান্তবর্তী সংঘাত-সহিংসতা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে এ আশংকাও রয়েছে নানা মহলের। এই প্রেক্ষাপটে নজরদারি বাড়াতে তো হবেই, একই সঙ্গে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঠেকানোর প্রস্তুতি রাখতে হবে।

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপট দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। যদি তা হয় তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম চালুর পথ দীর্ঘায়িত হবে। তবে মিয়ানমারে সৃষ্ট সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলেও আমাদের তাতে কিছু করার নেই। কারণ এ সংঘাতে আমরা কোনো পক্ষাবলম্বন করছি না। তাই পক্ষপাতহীনভাবে সমাধানকল্পে কাজ করার সুযোগ আমাদের রয়েছে। মিয়ানমারে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে জান্তা সরকারের পতন দীর্ঘায়িত হবে। অথবা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে বাকবদলের পরিণতি পেতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চালু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটি আমাদের করে যেতে হবে। এজন্য যা কিছু করণীয় তা নিশ্চিত করতে হবে কূটনৈতিক চ্যানেলকে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উত্তরোত্তর সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে চলেছে, যা আমাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট তাদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে তুলেছে। ক্যাম্পে খুনখারাবি বেড়েছে।

অভিযোগ আছে, মিয়ানমারের বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যেমন আরসা আমাদের এখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় তাদের শেকড়বাকড় গজিয়েছে তেমন এ সংগঠনগুলো নানাভাবে মিয়ানমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সম্প্রতি ২৫ জানুয়ারি ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার ২০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে অবস্থিত লাল পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে র‍্যাব আরসার গান গ্রুপের কমান্ডার উসমান নেসার ও ইমানকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ আছে, উসমান একসময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তাদের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। মিয়ানমারে সংকট বাড়লে এখানে অবস্থিত বিভিন্ন সংগঠনে পৃষ্ঠপোষকতা কমবে। ক্যাম্পে অবস্থানরত বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ করতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, এ অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। এসব বিষয় বিবেচনা করে ক্যাম্পে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে যাতে ধরনের অপশক্তি সংকটাবস্থা সৃষ্টি করতে না পারে।


  • নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা