× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অর্থনীতি ও জনজীবন

মূল্যস্ফীতির নৌকা চলে দুই বৈঠায়

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৩৪ এএম

আব্দুল বায়েস

আব্দুল বায়েস

নবনির্বাচিত সরকারের প্রথম টার্গেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। মন্ত্রিসভার প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দেন। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এর ধকল সবচেয়ে বেশি বহন করে গরিব শ্রেণি, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শেখ হাসিনার লক্ষ্য পিতার পথ ধরে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। কথায় বলে, মুখরা রমণীকে বশ করতে না পারলেও সংসার কোনোভাবে টিকে থাকে, কিন্তু লাগামহীন মূল্যস্ফীতি বশে আনতে না পারলে সমাজের সমূহ খতির আশঙ্কা থাকে। ঊর্ধ্বগামী মূল্যস্ফীতি ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে তুলতে পারে। স্মর্তব্য, পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমুখী মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে একবার দিল্লি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এর মধ্যে আছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ইতোমধ্যে খানার আয়ব্যয় সমীক্ষা (২০২২) জানাচ্ছে, আয়বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন গিনি সহগ নব্বইয়ের দশকের শূন্য দশমিক তিন পাঁচ থেকে ২০১০ সালে শূন্য দশমিক চার পাঁচ এবং ২০২২ সালে শূন্য দশমিক চার নয়) এবং মূল্যস্ফীতি, যা গরিবের ওপর রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের মতো, সেই বৈষম্যে জ্বালানি দিয়ে পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে। তবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য এ দুই সংকটের মধ্যে দারিদ্র্যহ্রাসের ইতিবাচক সংবাদে বাঁচোয়া বাংলাদেশ।

দুই

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জায়েদি সাত্তার মনে করেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমস্যার প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া।’ এমন উক্তির প্রায়শ উপেক্ষিত দিক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির ওপর বিনিময় হারের সঞ্চরণ বা ‘পাস-থ্রু প্রভাব’, এটা কমাতে মানসম্মত অস্ত্র (এবং লক্ষ্যমাত্রা যুদ্ধপূর্ববর্তী পাঁচ দশমিক পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ) এবং পৌঁছার সময়সীমা ইত্যাদি। আইএমএফ এক অসুখকর অনুভবের দিকে ঠেলে দেয় যখন প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ না পেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কয়েক মাস থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারে। এ দীর্ঘ বেদনাদায়ক প্রতীক্ষায় না থেকে গবেষক জায়েদি সাত্তার একটা ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ দেওয়ার কথা বলছেন।

প্রথমত, শুল্ককাঠামো যৌক্তিক করার সময় এসেছে এবং সেটা শুধু সমকক্ষদের সঙ্গে সমতুল্য করার জন্য নয়, বরং আমাদের রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করা এবং সংরক্ষণে রপ্তানি-বৈরিতা পরিহারের জন্য যা দীর্ঘকাল আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। শুল্কের হার কমানো বা যৌক্তিক করার ক্ষেত্রে একগুঁয়ে প্রতিরোধের পেছনে কারণ রাজস্ব হারানো (আহরণের বিপরীতে) এবং তথাকথিত ‘শিশুশিল্প’ যুক্তি যে এগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে বেড়ে ওঠার জন্য।

২০২২ সালে একই সময়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয়Ñ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত সাপ্লাই চেইন যার ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্য, জ্বালানি, সারের) এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার তির্যক অবমূল্যায়ন যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর অবধি ৩০ শতাংশের মতো। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস পেলেও এ দুই উৎসের দ্বিতীয় পর্বের প্রভাব অনুভূত হতে থাকল। ২০২২ সালের আগস্টে সরকার কর্তৃক জ্বালানির দাম ৫০ ভাগ বৃদ্ধি করেও লাভ হলো না। মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের নিচে থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপর চড়তে লাগল।

এটা এখন পরিষ্কার, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি প্রধানত ব্যয়বৃদ্ধি-তাড়িত। বিপর্যস্ত সাপলাই চেইন এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন একটা সরবরাহ ধাক্কা নিয়ে আসে যা মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয় এবং গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো অর্থ সম্প্রসারণ দ্বারা পুষ্ট হয়। অবশ্য দ্বিতীয়টি প্রচলিত পদ্ধতি/সুপারিশ যথা আর্থিক সংকোচন এবং সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ওল্টাতে সক্ষম হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে জুলাই, ২০২৩ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ (মূলত টাকা ছেপে নিরেট মূল্যস্ফীতিমুখী পদক্ষেপ) নেওয়ার তাগিদ স্থগিতকরণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে একটা নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি প্রত্যাশিত, যা রাজস্ব ঘাটতি মানিটাইজেশন সীমিত রাখবে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন সংকোচন নীতি হয়তো চাহিদা সংকোচনে ভূমিকা রাখবে কিন্তু আমদানির মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নসঞ্জাত সরবরাহ অভিঘাত মোকাবিলায় উপযুক্ত নয়। বস্তুত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত প্রকট আমদানি সংকোচনের ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে (স্বল্পতার সুযোগে) এবং এভাবেই সময়ের বিবর্তনে কষ্ট-পুশ ইনফ্লেশনে অতিরিক্ত একটা উপাদান হিসেবে যোগ হয়। মূল্যস্ফীতির একটা বিশেষ চালকের দিকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে মনোযোগ দেওয়া জরুরি এবং সেটা হলো বিনময় হারে ব্যাপক অবমূল্যায়ন। সামষ্টিক আর্থনীতিক স্থিতিশীলতার গাড়িটি উল্টে বা উবুড় করে দিয়েছে এমন ঘটনা কারও স্মৃতিতে জাগে বলে তো মনে হয় না। আর তাই উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিময় হার কীভাবে মূল্যস্ফীতি সঞ্চারিত করে সে সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এমন পাস-থ্রুর মাত্রা এবং পর্যাবৃত্ত মূলত নির্ভর করে আর্থনীতিক পরিবেশের ওপর যেমন (ক) বিনিময় হারের কতটুকু নমনীয় (খ) আমদানি-ভেদন (ইমপোর্ট পেনেট্রেশন), এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানির অংশ (গ) অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতিযোগী না একচেটিয়া কাঠামো (ঘ) বিদ্যমান বাণিজ্য অবমুক্তি এবং বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ।

তিন

দেখা গেছে, সঞ্চরণ বা পাস থ্রু ছিল প্রায় সমকালীন এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বিপুল অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন মূল্যস্ফীতি ধরে রাখে যেহেতু একে মোকাবিলা করার জন্য সমকালীন ক্ষতিপূরণমূলক বিপরীত পদক্ষেপ দৃশ্যমান ছিল না, এমনকি আলোচনায়ও স্থান পায়নি।। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কতটুকু সঞ্চরণের কারণে? গবেষক জায়েদি সাত্তারের মতে, মে, ২০০২ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ অবধি ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাস পায় প্রায় ৩০ শতাংশতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ আমদানি বাজারে খুব ক্ষুদ্র খেলোয়াড় বলে সে দাম প্রভাবিত করতে পারে না। অর্থাৎ দেশটি দেয় দামে বাণিজ্য করে (প্রাইস টেকার) এবং তার আমদানি চাহিদা রেখা অনুভূমিক। সুতরাং অভ্যন্তরীণ দাম আমদানি দামের প্রতিফলন ঘটায় (টাকায় দাম + শুল্ক, যদি থাকে) এর ফলে আমদানি দাম বৃদ্ধি পেলে (অবমূল্যায়নের ফলে মূল্যবৃদ্ধিসহ) অভ্যন্তরীণ বাজারে ওয়ান টু ওয়ান দাম বৃদ্ধি পায়। আইএমএফ এক হিসাবে বলছে বাংলাদেশে যদি মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হয়, তাহলে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে পাঁচ শতাংশ বা অর্ধেক আসে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে। যদি তাই হয় তাহলে আইএমএফসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান উঁচু শুল্ক (মোট কর আদায়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ) নিয়ে এতটা নীরব কেন?

অবশ্যই অধিক রাজস্ব আহরণ আমাদের কাম্য এবং তা কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি আছে। কিন্তু উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দিয়ে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করে রাজস্ব আদায় সবচেয়ে ভালো পন্থা নয়। আমরা অবগত আছি, শুল্ক যৌক্তিক না করার বা শুল্ক হ্রাসের ক্ষেত্রে একগুঁয়ে মনোভাব কাজ করে মূলত দুটি কারণে- রাজস্ব বৃদ্ধি ও স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা দেওয়া। তবে এখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছে সঞ্চারিত মূল্যস্ফীতি কমাতে শুল্কের হার কমিয়ে দেওয়া অর্থাৎ সঞ্চরণের ফলে যে ক্ষতি হয় তা পুষিয়ে নেওয়া।

এভাবেই না রাজস্ব আহরণ, না শিশুশিল্প সুরক্ষার যুক্তি ধোপে টেকে। তা ছাড়া আগের বছরের আমদানি সংকোচন থেকে সরে আসার তাগিদও রয়েছে। কারণ এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে অন্য এক সর্বনাশ উপহার দেয়। বিদ্যমান শুল্কের হার থেকে ৫-১০ এমনকি ১৫ শতাংশ কম হলে খুব তাড়াতাড়ি আমদানির অভ্যন্তরীণ দামে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে, সঙ্গে সুবিধা দেবে আমদানি বিকল্প ও উৎপাদন খরচেও। অতি দ্রুত মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে জরুরি ভিত্তিতে রেগুলেটরি ডিউটি তুলে দেওয়া উচিত। মোট কথা, উঁচু শুল্কের হার এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের মুখে আমদানি কর না কমালে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না

চার

মোট কথা দাঁড়ায় এই যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, একই সঙ্গে রাজস্ব নীতির যথাযথ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। মূল্যস্ফীতির উৎসের সন্ধানে আমরা দেখি টাকার অবমূল্যায়ন একটা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সে ক্ষেত্রে, শুল্কের হার হ্রাস করে আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমানো যেতে পারে। মূল্যস্ফীতির নৌকা চলে দুই বৈঠায়-মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি।

  • অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা