প্রজন্মের ভাবনা
মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৮ পিএম
গণিত যৌক্তিক ধারণার কবিতা- আলবার্ট আইনস্টাইনের এ একটি উক্তিই
বিজ্ঞানচর্চায় গণিতের গুরুত্ব উপস্থাপনে যথেষ্ট। গণিত বিজ্ঞানের ভাষা। মানবসভ্যতার
ক্রমাগত উন্নয়নের সঙ্গে গণিতের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। জীবনের প্রায় প্রতিটি
ক্ষেত্রেই রয়েছে গণিতের ব্যবহার। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে, গাণিতিক নিয়ম অনুসরণ করে
পৃথিবী, এমনকি মহাবিশ্বও। গণিতের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি এদের মধ্যকার
অন্তর্নিহিত কাঠামো। এ কারণে গণিতকে সব বিজ্ঞানের জননী বলা হয়। আদিকাল থেকে
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগেও বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখাসহ দৈনন্দিন জীবনের সর্বত্রই
গণিত ওতপ্রোত জড়িত। অ্যালার্মের মাধ্যমে ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত
সারা দিনই অতিবাহিত হয় গাণিতিকভাবে। নির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট কাজ করা,
দিনরাতের সময় ও বছরের হিসাব, যাপিত জীবনের জমাখরচের হিসাব, সমন্বয়ের ভাবনাÑসবই
গণিত। প্রাথমিক স্তরের গণিত বাদেও রয়েছে ক্যালকুলাস, লিনিয়ার অ্যালজেব্রা,
পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা, ডিসক্রিট ম্যাথমেটিকস। ডিজিটাল এ যুগে প্রোগ্রামিং
শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। প্রোগ্রামিংয়ের জন্য সহায়ক কম্পিউটার, সফটওয়্যার,
কোডিং, যাতায়াতব্যবস্থা, স্থাপত্যশিল্পসহ সবকিছুতেই উচ্চতর গণিতের জ্ঞান
অপরিহার্য।
বীজগণিত, জটিল সংখ্যা, ত্রিকোণমিতি ইত্যাদি প্রতিদিন আমাদের
জীবন প্রভাবিত করে। ওষুধ, আবহাওয়াবিদ্যা বা ক্রিপ্টোগ্রাফি এসব জনপ্রিয় বিষয়ে
গণিতের ব্যবহার হয়, যদিও আমরা তা বুঝতে পারি না। মহাকাশবিজ্ঞানে যেকোনো নক্ষত্র
কিংবা জ্যোতিষ্কের অবস্থান ও গতিবিধি নির্ধারণে উন্নত টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়
সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাণিতিক হিসাবনিকাশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিসংখ্যানবিদ কিংবা হিসাবরক্ষকদের যে তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় তার নির্ভুলতা
যাচাইয়ে গাণিতিক সমীকরণ জরুরি। সংখ্যা দিয়ে সঠিকভাবে বিন্যাসের জ্ঞান মানুষের আছে
বলেই বিশ্বকাপ ফুটবলে ৩২টি দলকে দিয়ে ৬৪টি ম্যাচ খেলিয়ে বিজয়ী বের করা যায়। শুরুতেই
যদি গাণিতিক পদ্ধতির আশ্রয় না নেওয়া হতো তাহলে সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩২টি
দলের মধ্যে একটি দলকে বিজয়ী ঘোষণা করতে আয়োজকদের ৫৩২টি খেলার আয়োজন করতে হতো। জীববিজ্ঞান,
অণুজীববিজ্ঞান, বংশগতিবিজ্ঞানের জেনোটাইপ-ফেনোটাইপ নির্ধারণে সংখ্যার বিন্যাসজ্ঞান
না থাকলে চলত না। পরিবেশের নান্দনিক সবকিছুর অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে গাণিতিক
যুক্তির সঠিক প্রয়োগ।
গবেষণার ক্ষেত্রে গণিতের প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। গবেষণার যেকোনো
ধরনের বাস্তবভিত্তিক মডেল তৈরি গণিত ছাড়া অসম্ভব। গণিত না থাকলে আজ যে মানুষের বিশাল
অগ্রগতি তা হতো না। কারণ এটি প্রাকৃতিক বিশ্বকে বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। গণিত
কণা ও তরঙ্গের আচরণ, তরল প্রবাহ এবং জটিল সিস্টেমের গতি বর্ণনা করে। খ্যাতনামা
জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও বলেছিলেন, ‘আমি যদি আবার পড়াশোনা শুরু করতাম
তবে প্লেটোর পরামর্শ অনুসরণ করে গণিত দিয়ে শুরু করতাম।’ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়
গণিতকে পরিবেশন করা হয় এমনভাবে যে আমরা ভয় পেয়ে যাই। শুধু গণিতের নিয়মটাই বুঝি,
বাস্তবিক প্রয়োগটা জানতে পারি না। কান্ট বলেছেন, ‘প্রকৃত বিজ্ঞান হলো সেই বিজ্ঞান,
যে বিজ্ঞান গাণিতিক।’ গণিত সব বিজ্ঞানকে নিখুঁত করে আধুনিক সভ্যতা গঠনে খুব
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গণিতে দক্ষ হয়ে উঠলে এবং গুরুত্বসহকারে অধ্যয়ন
করলে আমরা বিজ্ঞানচর্চায় আরও অগ্রসর হতে পারব। তাই প্রাথমিক শ্রেণি থেকে উচ্চ
মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত গণিত শিক্ষাকে আরও সুসংহত করে তুলতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে
যৌক্তিক জ্ঞানসম্পন্ন মেধাবী জনগোষ্ঠী, যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি
সাফল্যের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।