× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতেই হবে

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১৯ এএম

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘ভিকারুননিসায় আরেক পরিমল’ শিরোনামে শীর্ষ প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা যে কোনো শুভবোধ সম্পন্নকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ না করে পারে না। ইতোপূর্বে পরিমল নামে এক শিক্ষকের যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করে ভিকারুননেসা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এবারও কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনের বাংলাদেশ এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ পরিবেশন করলেও কর্তৃপক্ষের প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। স্কুল পরিচালনা পরিষদের কারও কারও ভাষ্যেও মনে হয় যে, মুরাদ হোসেন সরকার নামের বর্তমান পরিমলও খুব শক্তিশালী। তবে আশার কথা হলো, ছাত্রীদের বিক্ষোভ ও প্রতিদিনের বাংলাদেশ লেগে থাকায় ২৭ ফেব্রুয়ারি মুরাদ হোসেন গ্রেপ্তার হন এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অনাচার যেন একটা ব্যাধি হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো মাদ্রাসায় ছাত্রদের বলাৎকারও যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই বিকৃত মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে কেন এবং এটির সমাধানইবা কী? বর্তমান প্রতিবেদক যেহেতেু মনোবিশেষজ্ঞ নয়, তাই এ বিষয়ে শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করি, এটি একটি রোগ এবং এর জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয়। তবে এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নতুন নয়। 

আমাদের কালেও প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুয়েকজন শিক্ষক ছিলেন যারা এই দোষে দুষ্ট। কিন্তু মেয়ে শিক্ষার্থীরা ভয়ে কখনও মুখ খুলতে পারেনি। ভিকারুননেসার মেয়েদের ভাষ্যেও মনে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীই মুরাদের বিকৃত রুচি ও মানসিকতার শিকার হয়েছে; তারাও পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক সম্মানের ভয়ে কথা বলেনি। এবার যেহেতু একজন মুখ খুলেছে তাই থলে থেকে একের পর এক বিড়াল বেরিয়ে আসছে। স্কুল ও মাদ্রাসায় যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের নাম উল্লেখিত হয়নি। দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহে এই সমস্যা অনেকটা মহামারির মতো। সেজন্য বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন নিরোধ আইন বলবৎ করা হয়েছে। এই আইনটি হাইকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত। এই আইনের বলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যৌন নিপীড়ন নিরোধ কমিটি করা আছে। যেকোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা কর্মচারী এই কমিটির কাছে হেনস্থা হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করতে পারে এবং এই আইনের আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর এ বিষয়ে নির্লিপ্ততা লক্ষ করা যায়। নির্লিপ্ততা কেন, তা বোধগম্য নয়।


যে অভিযোগগুলো উঠছে তার বেশিরভাগই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। ফলে সমাজে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান ধীরে ধীরে তলানিতে ঠেকছে। সমাজে শিক্ষকদের ক্ষমতা ছিল না; তবে এক ধরনের প্রভাব ছিল। কিন্তু বিবিধ কারণে তা খর্ব হচ্ছে। প্লেটো শিক্ষকদের বলেছেন দার্শনিক। শিক্ষকের বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য থাকবে; আবার শিক্ষক হবেন সততার প্রতীক। তিনি সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, নির্লোভ, নিরহংকার হবেন। শিক্ষক হবেন আভিজাত্যের প্রতীক। কিন্তু সমগ্র সমাজ থেকে যখন এসব গুণাবলি তিরোহিত হচ্ছে, তখন শিক্ষকবৃন্দ এটি আর ধরে রাখবেন কেন। তাই পচনটা এখানেও ধরেছে। এক সময় শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। এখন বরং সবাই ক্ষমতার পদগুলোতে যেতে চায়। স্কুল ও কলেজে আমাদের শিক্ষকদের আর্থিক টানাপড়েনে থাকতে দেখেছি। কিন্তু তাও চলাফেরায় তাদের আভিজাত্য ছিল। কিন্তু এখন শুধু নাই নাই রব। এক সময় বেসরকারি কলেজের সুবিধা অনেক কম ছিল। কিন্তু এখন সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও অভাব যেন আরও বেড়েছে। এর কারণ সামগ্রিক অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। গ্রামের যে মানুষটি কর্মক্ষম বা কাজ করে খেতে অভ্যস্ত; এদের প্রত্যেকের হাতে কিছু না কিছু টাকা আছে। তাই শিক্ষকবৃন্দ পিছিয়ে থাকবে কেন। তাদের প্রচুর টাকা বানানো চাই। এই টাকার মেশিন হলো প্রাইভেট বা টিউশন। অর্থের লোভের সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় সব লোভের একটা সম্পর্ক আছে। কারণ এটা দেখা যায়, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মানুষরা অনেক ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত। অবৈধ ও নীতিহীন কাজ এক সময় এসব মানুষের নেশায় পরিণত হয়। আর এই নেশার আর এক নাম অসুখ বা রোগ। এই রোগ নিরাময়ের জন্য পরিবারকে এগিয়ে আসা দরকার, আবার কর্তৃপক্ষকেও শক্ত অবস্থানে থাকা প্রয়োজন। 

মা-বাবা, স্ত্রী বা সন্তানসন্ততি যদি অল্পে তুষ্ট থাকে, তবে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে বলে মনে হয়। যখন পরিবারের সদস্যরা শুধু চাই চাই করে, তখন এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রথমে অর্থের পেছনে ছোটে। অতঃপর সব অনৈতিকতা তাদের পেয়ে বসে। অন্যান্য পেশায়ও একই অবস্থা। শিক্ষকতায় তাদেরই আসা উচিত যারা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতে পারবেন। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, এমন অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যার শিক্ষকদের অনেকে জীবনে কোনো চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। কিন্তু এদের অনেকেই এখন আবার জাতীয়করণের দাবিতে সোচ্চার। বরং এনটিআরসি হওয়ার পর শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এখন এনটিআরসির পরীক্ষার মাধ্যমে নাহয় ভালো ছাত্রকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেল; কিন্তু নৈতিকতা পরিমাপের পরীক্ষা কী। এটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। তবে শুধুমাত্র শিক্ষকই যেহেতু একচেটিয়া এই দোষে দুষ্ট নয়, তাই কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ ধরনের অনৈতিক কাজ কমতে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যৌন নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা ও কমিটি আছে; এটি সব প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক চালু করা উচিত। তা নাহলে একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। 

সমাজে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে- এ বিষয়ে সমাজতত্ত্ববিদ ও মনোবিদদের গবেষণায় মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সমস্যা বিদ্যমান নয়; সমাজের সর্বত্র এটি বিরাজমান। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে দ্রুত জনসমক্ষে চলে আসে। আজ যে কন্যাসন্তানটি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তার অভিভাবকগণ এক ধরনের সামাজিক চাপে পড়বেন। কিন্তু এই চাপ থেকে এই পরিবারকে মুক্ত রাখতে পারেন সমাজেরই মানুষরা, তাদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সমাজ অভিযোগকারীকে দোষারোপ করছে। এজন্যই কিন্তু সহজে কেউ অভিযোগ করতে চায় না। আজ এই শিক্ষার্থীকে অন্যদের সাহস জোগানো উচিত। সে যে একা নয়, এটা তার সতীর্থরা আজ অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছে। সারা দিনই ভিকারুননেসা উত্তাল ছিল। কিন্তু অভিভাবকদেরও আরও এগিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি আজ যে শিশু, সে একসময়ে মা অথবা বাবা হবেন। তিনি মনে রাখবেন, তার সন্তানকে নীতিনৈতিকতা শিক্ষা দেবেন। আমরা যারা অভিভাবক হয়েছি তাদের উচিত মাঝেমধ্যে সন্তানদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলা। তারা যেন ভবিষ্যতে বিপথগামী না হয়, সেজন্য তাদের সচেতন করে গড়ে তোলা। আমরা চাই, সব পক্ষের বক্তব্যের সূত্র ধরে নিরপেক্ষ তদন্তক্রমে টিচার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের তদন্তে গরমিলের অভিযোগ উঠেছে। এরও উৎসে নজর পড়ুক। অভিযুক্ত বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। সত্য উদঘাটন চাই।

সম্প্রতি বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। এর মধ্যে অপরাধী অনেকের আবার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার খবর বেরিয়েছে। কিন্তু সে কারণে তদন্তের গতি মন্থর হওয়া সমীচীন নয়। অপরাধ সংঘটনের অনেক পরে বিচারকার্য সম্পন্ন হলে অপরাধ কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ অপরাধীরা মনে করবে এসব কোনো ব্যাপার নয়। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আমাদের পরিমলের কথা মনে আছে। সে হুমকি দিয়েছিল এই বলে, কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না। যদিও তার যথাযথ বিচার হয়েছে, কিন্তু অনেক বিলম্বে। মানুষ এত দিনে তাকে ভুল গিয়েছিল। অবশ্য বর্তমান ঘটনা সামনে এনে প্রতিদিনের বাংলাদেশ আবার তাকে মনে করিয়ে দিল। আমরা পূত-পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাই, যেখানে আমাদের সন্তানরা নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে চলাফেরা করতে পারবে। আমরা এমন শিক্ষক চাই, যাকে তার শিক্ষার্থীরা মাতা-পিতার মতো ভক্তি করবে, শ্রদ্ধা জানাবে। যখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে চলে যাবে; তারা অনেক বছর পরে এসেও সুখস্মৃতিকে রোমন্থন করবে। শিঙ্গাঙ্গণ অনাচার-দূরাচারের চারণভূমি হতে পারে না। পুরোনো শিক্ষকদের দেখলে তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা তার পায়ে নুইয়ে পড়বে, শিক্ষকের আশীর্বাদ কামনা করবে। এমনকি আজকে যারা শিক্ষার্থী একসময়ে তারা যখন মা-বাবা হবেন, তখন তারা তাদের সন্তানদের পুরোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসে তার জীবিত শিক্ষকদের দেখাবেন। শিক্ষকের চোখ তখন জলে ভরে উঠবে। তিনি তার সৃষ্টির অপার আনন্দ উপভোগ করবেন তার পুরোনো ছাত্রছাত্রীকে দেখে। 

একজন শিক্ষার্থী যখন জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে তার শিক্ষককে সংবাদ দেয় বা সাক্ষাৎ করতে আসে, একজন শিক্ষকের জীবনে এর চেয়ে প্রশান্তির কিছু থাকতে পারে না। আমরা এ ধরনের শিক্ষক চাই, যার কাছে শিক্ষার্থী সব সময়ে নিরাপদ। তিনি সব লোভের ঊর্ধ্বে থাকবেন। তার শিক্ষার্থীদের তিনি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা দেবেন। শিক্ষার্থীরা যেন বিপথগামী না হয়, তিনি সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। তবেই ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং এর মাধ্যমে আদর্শ সমাজ তৈরি হবে।

  • শিক্ষাবিদ।  সমাজ ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা