× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি

অগ্নিবিভীষিকার ‘তিলোত্তমা’য় মৃত্যুকূপ

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৯:১২ এএম

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩৭ এএম

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

শোকের ছায়া সরছে না। মহানগর-নগর-শহরই শুধু নয় দেশের প্রায় সর্বত্রই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার প্রতিফল হিসেবে জিইয়ে আছে মৃত্যুকূপ। সড়কে-নৌপথে কিংবা যাতায়াতের ও বসবাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখন যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছোবল জীবন-পরিবার-স্বজনকে স্তব্ধ করে দেয় বলা বড় ভার। ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার পর থেকে টিভি চ্যানেলের পর্দা আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংস্করণে বেদনার্ত খবর-চিত্র এবং দূর-অদূর থেকে সরাসরি প্রত্যক্ষ কিংবা সম্প্রচারিত দৃশ্যের মর্মস্পর্শী অবলোকন। অগ্নিবিভীষিকার ‘নন্দিত’ এ মহানগরে এমন দুঃসহতার মুখোমুখি দেশবাসীকে বিগত দেড় দশকে হতে হয়েছে বহুবার। নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, বঙ্গবাজার এবং রাজধানীর একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনার খতিয়ানে যুক্ত হলো বেইলি রোড। গত দেড় দশকে ঘটে যাওয়া মনুষ্যসৃষ্ট অগ্নিদুর্যোগে প্রাণহানি ঘটেছে কয়েকশো মানুষের। দগ্ধ হয়ে বিপন্ন জীবনযাপন করছেন কতজন, এর সঠিক হিসাব মেলানো যাবে না। এ সবই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, আইন কিংবা নিয়মনীতির প্রতি অবজ্ঞার ভয়াবহ ফল।


বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর ১ থেকে ২ মার্চের সংবাদপত্রের পাতাগুলো শুধুই মর্মন্তুদ খবর আর চিত্রে ঠাসা। গাফিলতির কারণে জিইয়ে থাকা মৃত্যুকূপে বারবার জীবন দগ্ধ হওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষের তরফেই উচ্চারিত হয়েছে প্রতিকার-প্রতিবিধানের ফের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যতগুলো অগ্নিদুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে এবং জীবন পুড়েছে, বিপন্নতা সঙ্গী করে যারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তাদের স্বজনদের কাছে দায়িত্বশীলদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বড় বেশি মর্মবেদনার। কারণ জীবনের ক্ষয়েও যেখানে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয় না উপরন্তু একপর্যায়ে সবই মিইয়ে যায় এবং আবার বিস্তৃত হয় মর্মস্পর্শিতার ছায়া তখন ক্ষোভ আর বেদনাই আবার সঙ্গী হয়। ক্ষণিকের জন্য জেগে ওঠেন দায়িত্বশীলরা, তারপর আবার সেই বিস্ময়কর-প্রশ্নবোধক দায়িত্বহীন মৌনতা! ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক গাফিলতির ক্ষতচিহ্ন জনপদজুড়ে। নগর পরিকল্পনাবিদ, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের তরফে নিরাপদ আবাস এবং পরিকল্পিত জীবনযাপন ব্যবস্থার পথ মসৃণ করার সুপারিশ-প্রস্তাব বহুবার উপস্থাপিত হয়েছে বটে কিন্তু কার্যত সবই নিষ্ফল। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দায়িত্বশীল পক্ষের দায়িত্বহীনতায় আর কত জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তি ঘটলে তাদের টনক নড়বে, এ প্রশ্ন আমরা বারবার উত্থাপন করছি বটে কিন্তু তাদের নির্বিকারত্ব যেন ‘কুম্ভকর্ণের নিদ্রা’কেও হার মানায়।

রাজধানী ঢাকাকে তিলোত্তমা হিসেবে গড়ে তোলার কত সুবচনই তো আমরা শুনলাম। পরিকল্পনাও ইতোমধ্যে কম হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘পরি’টা যেন উড়ে যাচ্ছে, কল্পনা রয়ে যাচ্ছে কল্পনায়ই! অনিয়ম যখন নিয়মে পরিণত হয় এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি যখন জেঁকে বসে তখন সুশাসন কিংবা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা দুরাশা বই কিছু নয়। বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পরদিন সেখানের কয়েকটি খাবার দোকান কর্তৃপক্ষ তাদের বাণিজ্য চালিয়েছে, এত হতাহতের মর্মস্পর্শিতাও তাদের স্পর্শ করেনি! তাতে এও প্রতীয়মান হলো, জীবন নয়; জীবন মুঠোবন্দি করে বাণিজ্যই মূল লক্ষ্য। একই সঙ্গে শোকের ছায়ায় আচ্ছাদিত ওখানের অন্য খাবারের দোকানগুলোয় যারা খেতে গেলেন তারা নিশ্চয়ই শুধু মানুষ নামের প্রাণিমাত্র। আমাদের সমাজ ক্রমাগত বিবর্ণ হওয়ার পেছনে এই প্রাণীরাও কম দায়ী নয়।

অগ্নিদুর্যোগসহ যেকোনো মর্মস্পর্শী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখই দেখেনি, এমন কথাও দুর্মুখেরা ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন-সুপারিশ উপস্থাপিত হলেও তা শেষ পর্যন্ত পড়ে যায় ফাইলচাপা! বেইলি রোডের বহুতল ভবন গ্রিন কটেজ নামক মৃত্যুকূপটি যেকোনো সময় হতাহতের দুঃসহ স্মারক হয়ে দাঁড়াতে পারে এ সতর্কবার্তা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তরফে কয়েকবার চিঠি দিয়ে জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ভবন কর্তৃপক্ষ তা আমলেই নেয়নি! অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর চিঠি কিংবা নোটিস ইস্যু করেই যেন তাদের দায়িত্ব খালাস! ওই ভবনটির নিচ থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কোনো অনুমোদন না থাকলেও কোন শক্তিবলে ভবন কর্তৃপক্ষ সেখানে রেস্টুরেন্ট কিংবা অন্যান্য দোকান খুলতে দিয়েছিল? অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অগ্নিঝুঁকি হ্রাসে করণীয় বিষয়ে ঘাটতি, অগ্নিদুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতার অভাব, অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ইত্যাদি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনাবিদরা ফের আরেক দফা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ ইতঃপূর্বে তারা বহুবার এসব ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিলেও তা যাদের আমলে নেওয়ার কথা তারা নেননি!

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল কিংবা উন্নত দেশে মহানগর-নগর-শহর অথবা যেকোনো জনপদে সুশাসন এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেসব দেশের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো শুধু কাগজপত্রই তৈরি করে না, নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করে এবং কোনো গাফিলতি পেলে যথাযথ শাস্তিও নিশ্চিত করে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, আমাদের এখানে কাগজপত্রে নিয়মনীতি কিংবা আইন লিপিবদ্ধ থাকলেও প্রয়োগের অনেক ক্ষেত্রেই বিবর্ণতা দৃশ্যমান। সভ্যতা-মানবতা-প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের উৎকর্ষকালেও আমাদের বিভিন্ন জনপদে নির্বিচার-অঘটনে যেভাবে প্রাণহানি ঘটছে তা বহুলাংশেই দুর্ঘটনা নয় বরং কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বললে অত্যুক্তি হবে না। বেইলি রোডের ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। যেভাবে ভবন কর্তৃপক্ষ ভবনটি পরিচালনা করছিল তাতে আইন কিংবা নিয়মনীতির কিছুরই প্রতিপালন হয়নি। এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় একই চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার-প্রতিবিধান নিশ্চিত হয়নি। কেন?  

বেইলি রোডের ওই ভবনে সেদিন যারা রেস্টুরেন্টে খেতে কিংবা কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন তাদের হয়তো অনেকেই রাষ্ট্রের ওপর ভরসা রেখেছিলেন জনগণের নিরাপত্তার সবকিছু নিশ্চিত করেই রাষ্ট্র ভবনটির অনুমোদন দিয়েছে। হ্যা, অনুমোদন ছিল বটে কিন্তু অনুমোদনের গর্ভে কিংবা এর বাইরে যা কিছু সেখানে চলছিল সবই অনিয়মের উৎকট নজির। এমনটি যে শুধু বেইলি রোডের ওই ভবনটির ক্ষেত্রে বিদ্যমান তাও নয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন নগর-শহর কিংবা অন্য জনপদে এ রকম ভবনের অস্তিত্ব জিইয়ে আছে অনেক।

চুড়িহাট্টা ঘটনার এত বছর পরও ‘কঠোর নির্দেশ’ সত্ত্বেও সেখানকার রাসায়নিক গুদামগুলো, যেগুলোকে অভিহিত করা হয় অগ্নিচুল্লি কিংবা বারুদের স্তূপ হিসেবে; সেগুলো এখনও সরানো যায়নি! জননিরাপত্তার জন্য ভয়ংকরভাবে যে বিষয়গুলো হুমকি হয়ে আছে সেগুলোর ব্যাপারে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র কথা দায়িত্বশীলদের মুখে শোনা যায় বটে, কিন্তু তা কতটা পরিহাসের বেইলি রোড ট্র্যাজেডি পুনর্বার এ সাক্ষ্যই দিয়েছে। একদিকে জিইয়ে আছে জননিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন অবহেলা-উদাসীনতা, অন্যদিকে ক্ষমতাবান-বলবানরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের জন্য আইন-নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আস্ফালন করছেন। বেইলি রোডের ঘটনার পর রাজউকসহ বিভিন্ন পক্ষ বলেছে, ভবন মালিক বিনা অনুমতিতে সেখানে অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়া এবং দগ্ধদের হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার বেদনাকাতর মুহূর্তে তাদের এ ‘অমিয় বাণী’ কি শোভনীয়? তারা যদি জানতেনই ভবন কর্তৃপক্ষ অনুমোদনহীনভাবে সেখানে অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করছিল তাহলে কেন এত দিনেও যথাযথ ব্যবস্থা নিলেন না? তাদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বারবার এমন দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশবাসীকে হতে হবে, অথচ তারা থেকে যাবেন আইনের আওতার বাইরে; তা তো হতে পারে না।

চুড়িহাট্টা, নিমতলী, বনানী, বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেট এ রকম অনেক ক্ষেত্রে মর্মন্তুদ ঘটনার পরও এসব দেখভালের দায়দায়িত্ব যাদের তাদের অনেকেই পার পেয়ে গেছেন। শুধু এ মহানগরীতেই নয়, দেশজুড়েই রয়েছে অসংখ্য ‘জতুগৃহ’। আমরা প্রত্যাশা করব, আর কোনো অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি নয়, কাজের কাজ হয়েছে। যাদের সুনির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব রয়েছে তাদের তা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে জবাবদিহির পাশাপাশি ব্যর্থতার জন্য আইনি ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি বিয়োগান্ত ঘটনার পর আমরা বরাবরের মতো এবারও আশ্বাসবাণী শুনছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আশ্বাসে বিশ্বাস রাখা এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়। সুশাসনের আলো যে পর্যন্ত না সর্বব্যাপী হবে সে পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারিতা-দায়িত্বহীনতার ছায়া সরানো দুরূহ। জীবন এবং স্বপ্ন সমান্তরালে পুড়তে থাকবে আর এ নিয়ে শুধু কথার কথার মধ্যেই করণীয় বিষয়গুলো সীমাবদ্ধ থাকবে, তাও হতে পারে না। মহানগর-নগর-শহরসহ দেশের সব জনপদে মানবতা, সভ্যতা ও নীতির আলো ছড়িয়ে পড়ুক। নিশ্চিত হোক সুশাসন। 

  • সাংবাদিক ও কবি
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা