× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতি

মাঝে মধ্যে আলোর ঝিলিক

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:০৫ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন

মহিউদ্দিন খান মোহন

গণতন্ত্রের প্রতি পরম আকাঙ্ক্ষাই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহা সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তান আমলে আমরা কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা পাইনি। সেই সঙ্গে বঞ্চিত হয়েছি অন্য সব নাগরিক অধিকার থেকে। এ বঞ্চনাই আমাদের মনে জ্বেলে দেয় দ্রোহের আগুন; যা থেকে জন্ম নেয় স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। এই প্রত্যয় আমাদের ধাবিত করে মুক্তি অর্জনের বন্ধুর পথে। ১৯৭১-এ রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল শোষণ-বঞ্চনার অবসানের পাশাপাশি আমরা পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারব। কিন্তু আমাদের সে প্রত্যাশা বারবার হোঁচট খেয়েছে, কখনোবা পড়েছে হুমড়ি খেয়ে। বাংলাদেশের আকাশে গণতন্ত্রের সূর্য কখনোই পূর্ণ আলোকরশ্মি বিকিরণ করতে পারেনি। সময়ে সময়ে নানান প্রতিবন্ধকতার মেঘ এসে তাকে ঢেকে দিয়েছে। ঠিক যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের প্রতিধ্বনি- ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না/ কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না…।’ এ যেন মাঝে মাঝে আলোর ঝিলিক।


আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুটি খবর বেরিয়েছে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে। একটি খবর হলো, ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে। অপর খবরটি হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম খবরটিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) তাদের গবেষণাপত্রে বলেছে, ২০২৩ সালে গণতন্ত্রের বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৮৭। ২০২২ সালে এক্ষেত্রে স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৯৯ এবং অবস্থান ছিল ৭৩তম। অন্যদিকে ৭ দশমিক ১৮ স্কোর নিয়ে ভারতের অবস্থান ৪১তম আর ৬ দশমিক ১৭ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭০তম। অর্থাৎ সূচক অনুয়ায়ী শ্রীলঙ্কার অবস্থান আমাদের চেয়ে ৫ ধাপ ওপরে। বছর দুয়েক আগে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক বিক্ষোভ, সরকারের দমননীতি, সংঘাত-সংঘর্ষ ও হানাহানি সত্ত্বেও গণতন্ত্র সূচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান আমাদের পাঁচ ধাপ ওপরে হওয়াটা বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। তাহলে কি শ্রীলঙ্কার জনগণ আমাদের চেয়ে বেশি গণতন্ত্র ভোগ করে? হবে হয়তো। 

জনগণের বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার হলো গণতন্ত্রের ব্যারোমিটার। এ দুটি অধিকার কোথায়, কতটুকু রয়েছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করে যে কোনো দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নির্ণয় করা যায়। বিশেষ করে নির্বাচনে জনগণ কতটা অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় দেশটিতে গণতন্ত্র কোন পর্যায়ে আছে। শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও সেখানে নির্বাচনে হয়তো জনগণ তাদের ভোটাধিকার অবাধে প্রয়োগ করতে পেরেছে। যার ফলে গণতন্ত্র সূচকে তাদের অবস্থান আমাদের ওপরে। যদিও আগের বছরের তুলনায় তারা ১০ ধাপ পিছিয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের গণতন্ত্রের অবস্থা কী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুকালে টিকা না দিলে শিশু যেমন পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে বেড়ে ওঠে, আমাদের গণতন্ত্রও সেভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতার পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলগুলো গণতন্ত্রকে নিজেদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করে একচ্ছত্র ভোগ করতে ব্যাপৃত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র নামের বৃক্ষটি মহিরুহ হয়ে উঠতে পারেনি, বনসাই হয়ে রয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করার অভিলাষে এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের কথা বলে সব সময়। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যে ভূমিকা রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের নেওয়া দরকার, তা তারা পালন করেন না কখনোই। তাদের কাছে গণতন্ত্র মানেই হলো নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া এবং টিকে থাকার কৌশল-অপকৌশল প্রয়োগ। আর সেজন্যই দেখা গেল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখায় যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের জন্ম, তা নিয়ে বড় দুটি দলের নানা কসরত। এক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের মনমতো রূপ দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করে ডেকে আনল বিপর্যয়। আরেক দল জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিল চিরবিদায় করে। ফলে যে ব্যবস্থাটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল, তা আজ নির্বাসিত। আর এ কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিভেদ-বিসম্বাদ আজ মীমাংসার অযোগ্য রূপ নিয়েছে। স্বৈরাচার হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পাশাপাশি হাঁটা বড় দল দুটি আজ বিপরীতমুখী অবস্থানে। যেন আজ দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। একটি দেশে গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ ও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, যখন এর স্টেক হোল্ডাররা অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সে আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে।

আজ দেশের বাইরে থেকে আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেওয়া হয়; যার প্রতিফলন ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারের মন্তব্যে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজির দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন প্রেস সেন্টারে এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, কৃষক, শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী করার ওপর নির্ভর করছে দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্র। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের জন্য ক্ষেত্র তৈরিতে মনোযোগী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রহ-উদ্বেগ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই আগ্রহকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখা যেতে পারে। বন্ধুর সমস্যা-সংকটে পরামর্শ দিয়ে বন্ধু ভূমিকা রেখে সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা যখন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে পর্যবসিত হয়, আপত্তি ওঠে তখনই। নিকট অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও বিএনপির সংঘাতময় অবস্থানের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অনেকটাই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল; যা দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারত। স্বস্তির বিষয়, শেষ অবধি যুক্তরাষ্ট্রের সংযত ভূমিকা সে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি। প্রশ্ন হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ, আমাদের গণতন্ত্রের জন্য তাদের ভূমিকা রাখতে হবে কেন? আমরা কি আমাদের গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারি না? বলাই বাহুল্য, এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু তা কি দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা পালন করছেন? যত দিন তারা এ বিষয়ে দায়িত্বশীল না হবেন, তত দিন গণতন্ত্র মেঘে ঢাকা সূর্য হয়েই থাকবে। রাজনীতিতে আরও বিস্তৃত হবে কদর্যতার ছায়া। 

  • সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা