পর্যবেক্ষণ
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪ ০৯:২২ এএম
আব্দুল বায়েস
ফেব্রুয়ারি বাঙালি তথা বাংলাদেশের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
মাস; এক অর্থে আবার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমনটি
বলছেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, ‘প্রাণের বিনিময়ে, রক্তগঙ্গা পেরিয়ে মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি
আদায় হয়েছিল পরাধীন দেশে।’ প্রতি
বছর নানা ব্যঞ্জনায় আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ফেব্রুয়ারি, বাঙালির জাতিসত্তা; স্বকীয়তা
আর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার রক্তাক্ত আন্দোলনের গৌরবগাথা রচিত মাস। আমাদের
স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনার মাস; আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস ইত্যাদি। শহীদ
রফিক, বরকত, সালাম ও জব্বারের রক্তে ভেজা রাজপথ ধরে আন্দোলনের ফসল আমাদের প্রিয় বর্তমান
বাংলাদেশ। সুতরাং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’।
তারপর অনেক জল গড়ায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বেয়ে এবং প্রায় বিশ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা
আন্দোলন শুরু হয় ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের অমর কথাখানি ধরে- ‘এবারের সংগ্রাম
মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
দুই
কিছুদিন আগে এ ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম দিনের প্রথম প্রহরে
আমন্ত্রিত ছিলাম এক অনন্য অনুষ্ঠানে। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সেমিনারে; যার শিরোনাম
ছিল ‘রেইজিং আ ভয়েস ফর ডিক্লারেশন অব সেভেন্টি ওয়ান কিলিংস অ্যাজ
জেনোসাইড’। আমার মনে হয়েছে ওটা বিবেক
জাগ্রত করার বিরল সেমিনার। বিরল এ কারণে যে, আজকাল জেনোসাইড বা গণহত্যা নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা যায় না;
যদিও প্রতিবেশী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর মিলিটারি জান্তার জেনোসাইড আমাদের চোখের
সামনেই ঘটেছিল এবং ঘটছে। দ্বিতীয়ত, একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা বিবেক
জাগরণী সেমিনারের আয়োজক, তা বুঝে উঠতে সময় নিয়েছিল বইকি।
নবনির্মিত মনজুর এলাহি অডিটোরিয়ামে প্রথম অনুষ্ঠান সেমিনারে
মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক, বক্তব্য
দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ। ইস্ট
ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম এম সহিদুল হাসানের স্বাগত বক্তব্যের পর
সমাপ্তিসূচক বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা-উপাচার্য এবং বর্তমানে উপদেষ্টা
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
তিন
দুই ঘণ্টার ওপর নিবিষ্ট নিবেদন। অনুষ্ঠানের শুরু হয় প্রখ্যাত
চলচিত্রকার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবি দিয়ে। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে দর্শক
ফিরে গেলেন ১৯৭১ সালের বিভীষিকাময় দিনগুলোয়Ñঅস্ত্রের ঝনঝনানি,
ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মিছিল, বৃদ্ধ এবং শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ… লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত
গোছকাছায় অস্ত্রহাতে বাঙালির প্রশিক্ষণÑ‘তোমার ভয় নেই মা
আমরা অস্ত্রহাতে লড়তে জানি…’। মফিদুল হক জেনোসাইড শব্দটির সূচনা এবং পৃথিবীর
বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত জেনোসাইডের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত এবং পরিণাম নিয়ে
প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। হিটলারের ইহুদি নিধন থেকে কম্বোডিয়া, বসনিয়া- হারজেগোভিনা
থেকে বাংলাদেশ এবং অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের জেনেসাইড তুলে ধরেন। তিনি বলেন,
জেনোসাইডের বাংলা প্রতিশব্দ ‘গণহত্যা’ ব্যবহৃত হয়ে এলেও এর একটা জুতসই পরিভাষার প্রয়োজন
আছে বলে মনে হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন
সাংবাদিক, কূটনীতিক এবং পর্যবেক্ষক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড
সম্পর্কে যেসব প্রামাণিক তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন, তিনি তার একটা
চিত্তাকর্ষক সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন শ্রোতাদের সামনে। জেনোসাইড ছিল এবং দুর্ভাগ্যবশত
এখনও আছে, হয়তো থাকবেও। তবে এ সেমিনারের সুবক্তার
মূল সূর ‘জেনোসাইডকে না বলি’ এবং বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত হত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আওয়াজ উঠুক। যুদ্ধাপরাধ বিচারের আইন বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছিলেন
এবং তাদের একটা অংশের বিচার হয়েছে এ আমলে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে গেছেন শহীদজননী
জাহানারা ইমাম। কিন্তু গণহত্যায় লিপ্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার পেয়ে গেছে
আন্তর্জাতিক আইন আর কূটনীতির ফাঁকফোকরে। এসব মিলিয়ে একাত্তরে সংঘটিত জেনোসাইডের
যেমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি, তেমন থেমে থাকেনি এ জঘন্য গণহত্যা।
খুব তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া ইমতিয়াজ আহমেদ জানালেন, পৃথিবীতে
বর্তমানে পিপলস রিপাবলিক আছে মাত্র চারটিÑচীন, উত্তর কোরিয়া, আলজেরিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায়
একমাত্র বাংলাদেশ। জনগণের যুদ্ধে প্রাপ্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু পিপলস রিপাবলিক হিসেবে
পরিচয় করিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন। জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা, প্রবন্ধ প্রকাশ এবং এর
বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর
জেনোসাইড স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের আবর্তনে কিছু কাজ হয়েছে কিন্তু এখনও
অনেক করার বাকি। তিনি আরও অবহিত করলেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার কথা। একাত্তরের জেনোসাইডের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হারিয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রী। এটা একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ছাত্ররা
প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে; যার ওপর একটা জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজন যেমন
একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতে শহীদ মিনারে জাতীয় শ্রদ্ধাঞ্জলিÑভার ন্যস্ত থাকে। বাংলাদেশে
ঘটে যাওয়া একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির আন্তর্জাতিক অনীহা কি ওই গণহত্যায় মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিল বলে?
চার
তরুণ প্রজন্মের প্রসঙ্গ এসেছে বক্তাদের বক্তব্যে। মফিদুল হক
বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মাত্র উনিশ বছর বয়সে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি লিখেছিলেন আর এ গানটির সুর করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ
যখন তার বয়স তেইশ বছর, ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের
ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছিল বাঙালি তরুণরা... স্বাধীনতাযুদ্ধেও তরুণরা। সুতরাং
গণহত্যার বিষয়ে জানা এবং এর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তরুণদের
এগিয়ে আসতে হবে। ইমতিয়াজ আহমেদ তরুণদের উদ্দেশে বলেন, অতীত থাকে রেফারেন্সের জন্য,
বর্তমান বলে কিছু নেই, থাকে একমাত্র ভবিষ্যৎ; যার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে
তরুণসমাজ।
পাঁচ
অনুষ্ঠানের সভাপতি মোহাম্মাদ ফরাসউদ্দিন সেমিনারের উদ্দেশ্য
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানালেন, মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে
যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, জেনোসাইড হিসেবে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পক্ষে দাবি
জানানো, বিশেষত তরুণসমাজের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া অভীষ্ট লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে দেওয়া তাঁর সেই সময়ের
ভাষণেও বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিচার দাবি
করেছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের জন্য প্রতিটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেমনটি আছে এখানে, ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ নামে একটি কোর্স থাকা
উচিত। বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নয়নে একটা স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
যে কোনো বিকল্প নেই, সে কথা সর্বপ্রথম অন্তরে অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যে কতটা সত্য ছিলেন তার প্রমাণ আজকের
বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়, প্রত্যাশিত আয়ু, প্রবৃদ্ধির হার, সামাজিক নির্দেশক, রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন
এক টাকার বিনিময়ে প্রায় তিন পাকিস্তানি রুপি পাওয়া যায় অথচ স্বাধীনতার আগে মিলত
কয়েক পয়সা মাত্র।
আসুন একাত্তরের হত্যা জেনোসাইড গণ্য করে এর কুশীলবদের যথাযথ
শাস্তির বিধান করে জেনোসাইডকে না বলি। মিয়ানমারে যে গণহত্যা চলছে তারও নিন্দা
জানাই এবং একই সুরে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলি। জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন প্রকৃত গণতান্ত্রিক, অসম্প্রদায়িক এবং
সাম্যবাদী এক বাংলাদেশ; যেখানে উন্নয়ন মানে সবার জন্য সমান সুযোগের সম্ভাবনা,
উন্নয়ন মানে অর্থ বা পেশিশক্তিনির্ভর নয় বরং মেধাভিত্তিক একটা সমাজ।
ছয়
অগ্নিঝরা মার্চকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে গাই : ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল/মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়/মোরা
প্রকৃতির মতো সচ্ছল/ মোরা আকাশের মতো বাধাহীন/মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন/বন্ধনহীন
জন্ম স্বাধীন/ চিত্তমুক্ত শতদল।/মোরা বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল...।