× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমার কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার

মহাদেব সাহা

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪ ০০:৪৭ এএম

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৩ এএম

আমার কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার

বঙ্গবন্ধুর মুখ, তাঁর সেই দীর্ঘকায় অনন্যসুন্দর ছবিটি কিছুতেই ভুলতে পারি না। তাঁর ছবি সর্বদা আমার চোখের সামনে ভাসে। বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম দেখেছিলাম খুব ছোটবেলায়। সে আমার এক পরম সৌভাগ্য। এখনও নিজেকে ধন্য মানি। বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের স্কৃলে একটি নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দিতে। পশ্চাশ দশকের মাঝামাঝি। তিনি তখনও বঙ্গবন্ধু হননি, সবার প্রিয় মুজিব ভাই। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত দীর্ঘ অবয়ব সেই অসামান্য মানুষটাকে দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।

তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটে আসে। আমাদের স্কুলের সেই ছোট মাঠটিতে তিল ধারণের জায়গা নেই, দুই পাশের রাস্তা ও আশপাশের জমিতে পর্যন্ত উপচে পড়েছে মানুষ। সেই প্রথম আমার বাংলার এই শ্রেষ্ঠ মানুষটি দেখা। আমার শিক্ষকরা আমাকে একটি কবিতা লিখতে বলেছিলেন সেই সভায় পড়ার জন্য। আমি তখন কী কবিতা লিখি, দৈনিক পত্রিকায় ছোটদের পাতায় এক-দুটি কবিতা ছাপা হয়, কীই-বা লিখতে পারি আমি। অতিসাধারণ ছন্দ মেলানো একটি কবিতা, বোধ হয় এ রকম, ‘তুমি আসিয়াছ ফুলজোড় তীরে ছায়াময় এই গ্রামে/ আমরা গড়েছি পাতার তোরণ মুজিব তোমার নামে’। এ রকমই একটি সমিল কিশোর কবিতা পড়ার জন্য সভায় আমার ডাক পড়ে। জীবনে সেই প্রথম মাইকের সামনে দাঁড়ানো। কিন্তু পড়তে গিয়ে আমার একটুও ভয় বা অসুবিধা হলো না। পরম নিশ্চিন্তে ওই বিশাল মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমি অজ্ঞাত অপরিচিতি গ্রামের এক কিশোর নিজের লেখা এই কবিতা পাঠ করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, কবিতা পড়া শেষ হতেই বঙ্গবন্ধু হাত বাড়িয়ে সস্নেহে আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমার মাথায় ও কপালে চুমু দিয়ে বড় কবি হওয়ার আশীর্বাদ করলেন। বক্তৃতা দিতে উঠেও প্রকাশ্যে জনসভায় আমি যে বড় হয়ে কবি হব আবারও বললেন সে কথা। এখানেই আমার সৌভাগ্যের শেষ নয়, আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরবর্তী চান্দাইকোনা গ্রামের আরও একটি স্কুলে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময়ও তিনি আমাকে জিপে তাঁর কোলের কাছে বসিয়ে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্নেহ, এই ভালোবাসা, এই অমূল্য আশীর্বাদ আমার কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আমি তাঁকে কীভাবে ভুলি? সেই তো আমার কবিজীবনের সূচনা। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলাদেশে আমি ক্রমেই আরও অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব। লিখতে চাই, কিছু লিখতে পারি না। 

এভাবেই সারা আগস্ট মাস কেটে গেল। সেপ্টেম্বরের দিকে গ্রামে বসে এ সময়ই আমি মনে মনে কিছু কবিতার খসড়া তৈরি করার চেষ্টা করি। মনে মনেই লিখে ফেলি :

কবে থেকে শুরু হলো এত দীর্ঘস্থায়ী রাত

অন্ধকারবেষ্টিত সবাই,

কেউ কি কোথাও জেগে নাই, বোন ভাই একা কি সদলে?

শুধু কিছু জলপাই রঙের ট্রাক, কালো বুট;

পরে কবিতাটি শেষ করে নাম দিই ‘ভোরের প্রসঙ্গ’। আমার গ্রামের বাড়িতে বসে মনে মনে আরও একটি কবিতার খসড়া তৈরি করে ফেলি : 

আলস্যে ছিলাম এত দিন, আলস্যই ভালো!

আলস্যে ছিলাম, এত দিন, কোথায় পড়েছে ভেঙে বাজ

রাজমুকুটেরই বা কী হাল আজকাল আমি কি জানি না!

আমি জানি না কারা গোলাপের সঙ্গে এত গোলযোগ করে,

এমন হিংসায় হাসে, হাহাকারে হাসে

একদিন কীভাবে বা ভেঙে পড়ে মহিরুহ মুহূর্তের ঝড়ে।

‘আলস্য প্রহর’ নামে এ কবিতাটি আমার ‘কী সুন্দর অন্ধ’ বইটিতে অন্তর্ভুক্ত করি। আরও পরে আমি ঢাকায় এসে ‘আমি কী বলতে পেরেছিলাম’ এই দীর্ঘ কবিতাটিও এভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে লিখেছিলাম। পরে আমার আজিমপুরের এক রুমের বাসায় ছোট্ট টেবিলে বসে কবিতাটি মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে খাতায় লিখে ফেলি। আর সত্যি সত্যি সেই টেবিলের সামনে লম্বা একটা ক্যালেন্ডারে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি ছিল। আজ মনে হয়, বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে এত দীর্ঘ কবিতা আমি এভাবে লিখতে পারতাম না। ভাবি, বঙ্গবন্ধুই বোধ হয় আমাকে দিয়ে এই কবিতাটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন। এ যেন তাঁকে নিয়ে লেখা তাঁরই কবিতা, তিনিই আসলে এ কবিতার কবি। তিনিই তো একদিন আমার মাথায় হাত রেখে কবিতা লিখতে বলেছিলেন, কী করে ভুলে যাই? এসব কথা কেবল আমার অন্তরাত্মাই জানে। 

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট আমরা কী হারিয়েছি এখন আরও ভালো করে বুঝতে পারি। সেদিন সেই রাতে আমরা শূন্য হয়ে গেছি, নিঃস্ব আমরা। বাংলার বুক খালি হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ বহু শতাব্দী পরে হয়তো একজন জন্মান। তার জন্য আমাদের আরও কত সহস্র বছর অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে। এ কথা যখনই ভাবি তখন বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা