মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪ ০০:৫৩ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৪ এএম
দীর্ঘ জীবন পাননি বঙ্গবন্ধু। তাঁকে সেটা পেতে দেয়নি ঘাতকরা। ফলে জীবনের দৈর্ঘ্যের চেয়ে কর্মের পরিধি ও গভীরতা দিয়েই তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে। আর এই মূল্যায়নে মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিনের জীবন নিয়ে হাজার বছরে বাঙালির সবচেয়ে দীর্ঘতম কর্মবীর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। যতই দিন যাচ্ছে শুধু বাংলাদেশ নয়- বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই তত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন তিনি। এক্ষেত্রে আলোচনায় শুধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নয়, পুরো অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শন এবং চিন্তাও রয়েছে।
রাজনীতিতে ধূমকেতুর মতো উদয় হননি। একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে এসে জায়গা করে নিয়েছেন, এমনও নয়। অবিভক্ত বাংলার কথা যদি বলি- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো বৃহৎ নেতৃত্বের ছায়ার মধ্যেও তরুণ শেখ মুজিব ঢাকা পড়েননি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কিংবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো নেতার মধ্যেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ছিলেন এক বিশিষ্ট অবয়ব।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখি- দেশভাগের দিন থেকেই তিনি নতুন ব্যবস্থাকে ‘অসম্পূর্ণ’ মনে করছেন। কেবল বাংলার বিভক্তি নয়, স্বাধীনতার মর্মার্থ বিবেচনাতেও। শেখ মুজিব বলছেন- ‘স্বাধীন দেশের জনগণকে গড়তে হলে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হলে যে নতুন মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তা এই নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করতে পারলেন না। এদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগকে তাদের হাতের মুঠায় নেবার জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৯০)।
পরবর্তীকালে আমরা আরও দেখতে পাই, যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের তারুণ্য উৎসর্গ করেছিলেন, সেই পাকিস্তানেই তাঁকে নানা ছুতোয় কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহের অপবাদ। তখনও তিনি একজন উদীয়মান নেতা। বড় নেতারা যখন নানামাত্রিক আপস করে নতুন দেশের পদ-পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন, তখন ক্রমেই গড়ে উঠছে শেখ মুজিবের আপসহীন ভাবমূর্তি। নবাব, খানবাহাদুর, ভূস্বামী, অভিজাত শ্রেণির বাইরের বিপুল জনসাধারণের নেতা হয়ে উঠছেন তিনি। নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষাকে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ কিংবা ‘আমার দেখা নয়াচীন’- বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখনীতে আমরা দেখতে পাই, তিনি ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের সাক্ষী কেবল নন, কেবল দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা বলছেন না, কেবল নতুন চীনের সঙ্গে নতুন পাকিস্তানের তুলনা করছেন না। এই তিন গ্রন্থের পাতায় পাতায় ফুটে উঠছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ে তোলার আশা। একটি নতুন জাতির জন্মমুহূর্তের বৈভব ও বেদনা। তিনি তখনই স্থির লক্ষ্য- বিনা সংগ্রামে, বিনা ত্যাগে মুক্তি আসবে না। আর সেজন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব। সমাজের ওপরতলা থেকে পাখির চোখে দেশ দেখা নেতা নয়, গণমানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার নেতৃত্ব।
জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হলে ত্যাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও বলেছেন- ‘যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভালো কাজ করতে পারে নাই- এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১২৮)।
কারাগারের রোজনামচায় আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাসের একটি রূপরেখা স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করছেন। ধ্রুপদি অর্থে তিনি কমিউনিস্ট না হয়েও শোষক ও শোষিতের চিরন্তন সংগ্রামের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় উপলব্ধির কথা বলছেন। বলছেন- ‘শোষক ও শোষিতের মধ্যে সংগ্রাম হয়েই থাকে এবং হবেও। শোষকদের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১৮৭)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি যদি আমরা দেখি, দেখতে পাই গভীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলছেন শোষকের বিরুদ্ধে নিরলস নেতা হিসেবে। জেল, জুলুম, হুলিয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির মন্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন মানুষের মধ্যেই। নিজে প্রস্তুত হচ্ছেন, জাতিকে প্রস্তুত করছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য।
দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আসলে যেমন নিজেকে চেনাচ্ছিলেন, তেমনই চিনছিলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ জমিন ও তার রক্তিম ভবিষ্যৎকে। তিনি হয়ে উঠছিলেন বাঙালি জাতির বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক। হয়ে উঠছিলেন জাতির পিতা। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি করছিলেন। কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিরও প্রেক্ষাপট তৈরি করছিলেন নিজের জীবনের সোনালি সময়গুলো ব্যয় করে।
বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও সংগ্রাম বৃথা যায়নি। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বিস্ময় ছড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতিরও অনুপ্রেরণার নাম, মুক্তির মন্ত্র। তবে দুর্ভাগ্য আমাদের, যে স্বপ্নের সোনার বাংলা বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন, সেই সময় তিনি পাননি। সারা জীবন তিনি যে রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ রূপ তিনি দিয়ে যেতে পারেননি।
অতীত ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে বুঝতে হলে বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে হবে। এই ভূখণ্ডের সোঁদামাটির গন্ধ তাঁর জীবন, আদর্শ ও কর্মের পরতে পরতে মিশে রয়েছে। কেবল তাঁর রাজনৈতিক জীবন নয়; রাজনীতির সমান্তরালে তিনি যে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন, সেটাও বুঝতে হবে।
বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরে রাজনৈতিক মুক্তির পর সুবর্ণজয়ন্তী পেরোনো স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যদি সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন করতে চাই, তাহলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আঁকড়ে ধরার বিকল্প নেই। অস্বীকার করার অবকাশ নেই- গত অর্ধশতকে বিশেষত বঙ্গবন্ধুর আত্মজা শেখ হাসিনার টানা চার মেয়াদসহ চলমান পঞ্চম মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কম নয়। কয়েক বছর আগে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। জাতিসংঘের পর্যালোচনায় স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করেছি। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা এখনও বহুলাংশে অধরা। কখনও কখনও মনে হয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন আগের চেয়েও ধূমায়িত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নটিও যেন ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক মুক্তির দিগন্তে সবচেয়ে বড় বাধা যে সাম্প্রদায়িকতার পর্বত, সে কথা ভুলে যাওয়া চলবে না। আজ তাই আমার কাছে বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি বড় সংগ্রাম ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি যদি আমরা দেখি, দেখতে পাই গভীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। জেল, জুলুম, হুলিয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির মন্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন মানুষের মধ্যেই। নিজে প্রস্তুত হচ্ছেন, জাতিকে প্রস্তুত করছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য। পাশাপাশি নিজের অসাম্প্রদায়িক চেতনাও ক্রমে শানিত করে তুলছেন।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধির উচ্চতা দেখে যেমন মুগ্ধ, তেমনই বিস্মিত হতে হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্কুল পরিদর্শন নিয়ে একটি সভায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রসঙ্গে কিশোর মুজিবের প্রাজ্ঞ উপলব্ধিÑ ‘আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। এই যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, কাউকে ধর্মের ভিত্তিতে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখা, এই বোধ আমরা উপমহাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যে পরিণত বয়সেও দেখতে পাই না।
বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ও সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী, তখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষত ১৯৪৬ সালে অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। তখনকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু-এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। আমার মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
পরবর্তী সময়েও বঙ্গবন্ধু অনেকবার সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার দেখেছেন। তাই পঞ্চাশের দশকে চীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে দোলা দেয় অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। তিনি লেখেনÑ ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলতো তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে’ (আমার দেখা নয়াচীন)।
এটা সত্য, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মী ছিলেন। কিন্তু সেখানেও আমরা তাঁর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থানের সুবর্ণ পথরেখা দেখি। তিনি মনে করেছিলেন, হিন্দু জমিদারির বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খেটে খাওয়া চাষি মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। যে কারণে পাকিস্তান আন্দোলনেও তাঁকে আমরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা খাজা নাজিমুদ্দিনদের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির বদলে মুসলিম লীগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা আবুল হাশিমসহ উদারপন্থি ধারার সঙ্গে দেখি। আর যখন দেখেছেন, মুসলিম লীগের শাসনামলে হিন্দু জমিদারদের বদলে মুসলিম জোতদার, নবাবদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, তখনই তিনি মুসলিম লীগের বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভেবেছেন এবং মাঠে নেমে পড়েছেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। প্রথমদিকে দলের নাম ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ হলেও পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনির্বিশেষে সবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছেন। আর ষাটের দশকে ছয় দফার মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মুসলিম বা হিন্দু নয়, পূর্ব বাংলার মানুষের একটাই পরিচয়Ñ তারা বাঙালি। তাদের স্বাধিকারের প্রশ্নে তাই কেবল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক মুক্তি জরুরি। যে কারণে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি যুক্ত করেছিলেন।
বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে বাঙালিকে স্বাধিকারের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। আমি বলব, তিনি একই সঙ্গে বাঙালিকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্যও প্রস্তুত করেছিলেন।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও বঙ্গবন্ধু তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেনÑ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন সম্ভব নয়। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাই বলেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।... মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেÑ তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেÑ তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেÑ কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, দক্ষিণ এশিয়ারও দুর্ভাগ্য- বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু যে গোটা উপমহাদেশের জন্য আদর্শ, সেই কথা বলেছেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে আয়োজিত এক সভায় তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছেন সম্রাট আকবরের সঙ্গে। তিনি বলেছেন- ‘শেখ মুজিব এবং সম্রাট আকবর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি যেভাবে পরিষ্কার করেছিলেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া কেবল ভারতে নয়, অনেক দেশেই গুরুত্বপূর্ণ।’
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে কেবল শারীরিকভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারাইনি; গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুমহান আদর্শগুলোও হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাংলাদেশ যেন ভূতের মতো যাত্রা করেছিল পেছনের দিকে, অন্ধকারের অভিমুখে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে নাÑ এমন বর্বরোচিত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পুনর্বাসিত হচ্ছিল যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ অন্যান্য মূলনীতির ওপরও আঘাত হানা হয়।
অনেক নিরাশার মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়েছেন বঙ্গবন্ধুরই যোগ্য উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেবল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন, আওয়ামী লীগপ্রধান হিসেবে, এমনকি ব্যক্তি হিসেবেও তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টা নিরলস চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি মনে করি আওয়ামী লীগকে এক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিতে হবে। অন্যথায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন সহজ হবে না।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িকÑ তারা হীন, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।... আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনো দিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’
আওয়ামী লীগ তো বটেই, অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও আজ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান শোনা উচিত। তাহলেই আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করতে পারব। রাজনৈতিক মুক্তির অর্ধশতক পর অর্থনৈতিক মুক্তি টেকসই এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি সম্ভব করে তুলতে পারব। আমাদের সেজন্য প্রস্তুত হতে হবে।
লেখক : সম্পাদক, প্রতিদিনের বাংলাদেশ