সেলিনা হোসেন
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪ ০০:৫৬ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৪ এএম
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের অধ্যায়জুড়ে রয়েছেন। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫, পঞ্চান্ন বছরের মহাকাব্যিক সংগ্রামী জীবনে তিনি এক মহাকাব্য। প্রাকৃতিক লীলাসৌন্দর্যের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী ‘খোকা’ পর্যায়ক্রমে কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন, এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং আলোকিত। পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা আমাদের জাতির ইতিহাসে তিনি যেন মুক্তির দূত হয়ে জন্মেছিলেন। সেদিনের সেই শিশু ‘খোকা’ই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। রাজনীতির কবি হিসেবে খ্যাত মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর আজ জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণেই তিনি পরিণত বয়সে আলোর স্তম্ভ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
কিশোর বয়সেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবার কারাবরণ করেন। তারপর আর থেমে থাকা নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনÑ প্রতিটি পর্বে তাঁর দৃঢ়দৃপ্ত নেতৃত্ব এবং দূরদর্শিতা আমাদের মুক্তির পথ রচনা করে দেয়। তাঁর ডাকে ও নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। শিশু-কিশোরপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পর্ব আমাদের উজ্জীবিত করে এবং তা ধারণ করেই আমরা উজ্জীবিত থাকবোও। শিশুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা-ও যথার্থ।
বঙ্গবন্ধু নামটির সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন হেঁটে চলে এবং তা চলতেই থাকবে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বে জাতির বাঁক পরিবর্তনের ইতিহাসে তিনি তর্জনী উত্থিত করে এ মার্চেই রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতার পথরেখা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাঁর দৃষ্টি মেলে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্মরণ করি, কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কিংবদন্তি বিপ্লবী বিশ্বনেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ আমাদের অর্জনের কোন অধ্যায়ে নেই তিনি? আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের পথিকৃৎ তিনিই। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এ অমূল্য গ্রন্থগুলো পাঠ করলে নতুন আরেক বঙ্গবন্ধুকে আমরা পাই। জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটে তাঁর কারাগারে। ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ তাঁর রচিত প্রতিটি গ্রন্থ প্রজন্মের বারবার অধ্যয়ন করা উচিত। আমাদের আলোকস্তম্ভ বঙ্গবন্ধুকে জানতে এবং প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাঁকে ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই। মার্চ এলে সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বারবার আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে পর্যালোচিত হতে থাকে।
ডিসেম্বরে মার্চের সূত্র ধরেই বিজয়ের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায়ও নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে সঙ্গত কারণেই উপস্থাপিত হয় প্রেরণার নতুন উজ্জীবনী মন্ত্রে। আজকের শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এই শিশুদের যথাযথভাবে ইতিহাস-আশ্রিত করে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে। আধুনিক বিশ্বে সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা আছে। অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, জ্ঞান, ক্রীড়া ইত্যাদি কত কিছুর প্রতিযোগিতা। তবে সবার ওপরে মেধা-মনন ও সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশ নিতে হবে এবং প্রতিযোগিতার পর্বে পর্বে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেই এগোতে হবে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের নির্ভয় হতে শিখিয়েছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে বিশ্বের বুকে সম্ভাবনাময় একটি দেশের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। আজকের যে শিশু আগামী দিনে পরিণত মানুষ হবে, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, বিশ্বে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে সেই শিশুদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমরা জাতীয় শিশু দিবস উদ্যাপন করি; যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শিশুদের তো বটেই আমাদের সবার সামনেই এক অনুসরণীয় জীবন অধ্যায়। তাঁর দৃঢ়দৃপ্ত উচ্চারণ, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বিকশিত নেতৃত্বের আলো আমাদের পথ দেখিয়ে নিচ্ছে এবং নেবে। অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাদেশে প্রোজ্জ্বলিত চেতনার স্তম্ভ গড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই কবেই তো প্রমাণ করেছিলেন, আদর্শ ও দৃঢ়তাই মুক্তির পথ বাতলে দিতে পারে। আজকের শিশুরা বঙ্গবন্ধুর এ শক্তি ধারণ করেই বেড়ে উঠুক। জাতি তাঁর আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাক। শিশুদের তো বটেই আমাদের সবার সামনেই জ্বলতে থাকুক মঙ্গলপ্রদীপ।
আমাদের সাহিত্যে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁকে নিয়ে যেমন অসংখ্য বই রয়েছে তেমন এর পটভূমিও অনেক বিস্তৃত। আমি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গল্প লিখেছি। ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ পটভূমি কেন্দ্র করে ‘আগস্টের এক রাত’ নামে একটি উপন্যাসও লিখেছি। আরও কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি! বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে পাহাড়সম। বঙ্গবন্ধুর জন্যই আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।
১৯৭০ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে যোগদান করি। ১৯৭১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে আমি সরাসরি দেখতে পাই। সেদিন তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল বাংলা একাডেমির বইমেলা উদ্বোধন এবং যেসব বিদেশি বাংলা একাডেমিতে বাংলা শিখতেন তাদের সনদ প্রদানের জন্য। তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বটমূলে। শত শত শ্রোতার সামনে মঞ্চে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ একজন এসে বঙ্গবন্ধুর কানে কী যেন বলে গেলেন। তখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল তিনি ক্ষুব্ধ হলেন, উত্তেজিত হলেন। কিন্তু কোনো কিছু উচ্চারণ করেননি, কোনো কথা বলেননি। ওই ঘটনার প্রেক্ষাপট পড়ে জেনেছিলাম। সেদিন আমার আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কীভাবে সংস্কৃতি চেতনায় সব মানুষকে আবেগমথিত করতে পারেন। তাঁর বক্তব্য শুনে খুবই উজ্জীবিত হয়েছিলাম। আমার কাছে ওই দিনটি বড় একটি শিক্ষণীয় অধ্যায় এবং তা এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
বাঙালি ও বাংলাদেশ ছাপিয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনেসকোর স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাসী ৭ মার্চের ভাষণ নতুনভাবে জানতে ও বুঝতে পারছে। ইতিহাস ৭ মার্চকে যুগ যুগ ধরে গৌরব ও শক্তির একটি বৃহত্তম জায়গা থেকে দেখবে। বিশেষ করে একটি রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের গুরুত্ব কখনও শেষ হবে না। এটি একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে গেলে এমন দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সমান্তরাল। তাঁকে বাদ দিয়ে কখনই বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ হবে না। তিনি বাঙালির আত্মদর্শনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিভাস। এমন নিগূঢ় চেতনায় বাঙালির মৌল অনুভব অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। সামগ্রিকভাবে সত্যটা হলো, তিনি আমাদের শেকড়ের মানুষ। নিজের জাতিসত্তা এবং গণমানুষের পরিচয়ের প্রশ্নে তাঁর রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনবোধ কতটা পুষ্ট নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
বিশ্বের কোনো আধুনিক রাষ্ট্রই আপন পরিচয়ের বাইরে থাকতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রের মূল চিন্তায় বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ও আধুনিক মনের অধিকারী ছিলেন এরও সাক্ষ্য মেলে তাঁর রাজনৈতিক এবং সরকার পরিচালনার অধ্যায়জুড়ে। তাঁর একটি অসাধারণ উক্তি উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিবিড় উৎস ভালোবাসার, অক্ষয় ভালোবাসার; যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ তাঁর এ রকম আরও কত অসাধারণ উক্তিই তো স্মরণ করা যায়।
ধারাবাহিক চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে সরকারের নির্বাহী প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব-দূরদর্শিতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে অনন্য উচ্চতায় আসীন। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়তে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। আমরা চাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। মানুষের অধিকারের সমতল জমিনের বাংলাদেশ। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আরও বেশি আশান্বিত করে। এও বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লালন এবং তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে গেলে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের ঠিকানায় আমরা পৌঁছাতে পারব।
জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি