× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জনপ্রশাসন

জনকল্যাণের অঙ্গীকার থাকুক অগ্রভাগে

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১২:৫৫ পিএম

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

জনপ্রশাসন সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সরকার তার নীতি ও কর্মের বাস্তবায়ন করে থাকে এর মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশের জনপ্রশাসনের দায়িত্বশীল কাউকে কাউকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই নেতিবাচক কিছু প্রশ্ন উঠে। ২০ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে জনপ্রশাসনে পদোন্নতির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হচ্ছে। জনপ্রশাসনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হতে পারে। নিয়ম অনুসারে, রাষ্ট্রপতি যদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তাহলে জনপ্রশাসনে ৫-১০ শতাংশ পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের উপকারও হয়ে থাকে। প্রজাতন্ত্রের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জনপ্রশাসনে কাজ করার সুযোগ পান। বিভিন্ন বিষয়ে তারা সরকারকে সাহায্য করেন এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তা যেন প্রকট হয়ে না ওঠে। মাঠপ্রশাসনের কর্মীরা দীর্ঘদিন কাজ করে এবং প্রশিক্ষণ পেয়েই মূলত পদোন্নতি পেয়ে ওপরের স্তরে আসেন। ইউএনও থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক পর্যন্ত সবাই এ কাতারভুক্ত তা বলা যায়। এসব বিষয় বিবেচনা করে জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যত কম রাখা যায় ততই মঙ্গল। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেলে কর্মীরাও উৎসাহিত হন। যখন পদোন্নতি সুষ্ঠুভাবে হয় তখন ভবিষ্যতে বড় কোনো দায়িত্ব পেলে সেসব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি সচেতন হবেন কিংবা দায়িত্বশীল হওয়ার বিষয়ে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই যেহেতু এটি নানাভাবে প্রশাসনকে সহযোগিতা করে। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংযত হওয়া জরুরি তো অবশ্যই। এ ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যা সীমাবদ্ধ করে রাখলে জনপ্রশাসনের কর্মীরাও এখানে কাজ করার সুযোগ পাবেন।


প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, শীর্ষ পদে ঢালাওভাবে নিয়োগ থামছে না। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ কারণে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। প্রশাসনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় অনভিজ্ঞ চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, এ অভিযোগও রয়েছে। ঢালাওভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা পড়েন বিপাকে। প্রথমত জনপ্রশাসনের কর্মীদের সবার মনেই পদোন্নতির প্রত্যাশা থাকে। জনপ্রশাসনের প্রতিটি ধাপ উতরে তারা শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে প্রশাসনের হায়ারার্কির মধ্যে এক ধরনের অসামঞ্জস্য অবস্থা তৈরি হয়। এমনকি জনপ্রশাসনে দীর্ঘদিন কর্মরত কর্মীদের মধ্যেও নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হয়। এসব বিষয় সরকারকে ভাবতে হবে অবশ্যই। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়, প্রশাসনে শূন্যপদ থাকলেও সেগুলো পূরণ না করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে পদ পূরণ করার বিষয়টি নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। তবে কোনো কর্মকর্তা যদি যোগ্য হন এবং প্রশাসনের কাজে দক্ষ হন তাহলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়, কিন্তু অবশ্যই তা যেন ঢালাওভাবে না হয় কিংবা চলে এ ব্যাপারে সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট কোটা রয়েছে। আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, শূন্যপদ পূরণের প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি। নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের এই শূন্যপদের কথা পিএসসিকে জানায়। পিএসসি এর পরীক্ষা নিয়ে থাকে। পরীক্ষার মাধ্যমে একটি লিস্ট তৈরি করা হয়। ওই লিস্টের প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন এমনকি মন্ত্রণালয়ের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াও রয়েছে। এভাবে শূন্যপদ পূরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। করোনা মহামারির কারণে জনপ্রশাসনের অনেক পদ খালি হয়ে গেছে। সেটিও চার বছর আগের কথা। এখনও নানা কারণে প্রশাসনে অনেকগুলো পদ খালি রয়েছে। জনপ্রশাসনে প্রায় ৫ লাখ পদ খালি রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে সরকারি কর্মকর্তার পদ রয়েছে ২২ লাখ। তার মধ্যে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৩ পদই খালি। প্রশাসনিক ক্যাডারেই ১৯ হাজারের সামান্য বেশি পদ খালি রয়েছে। এ পদ পূরণের জন্য মোপা সম্প্রতি প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে দুয়েকটি মন্ত্রণালয় শূন্যপদ পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেও বাকি মন্ত্রণালয় তা পারেনি। শূন্যপদগুলো পূরণ করতে পারলে প্রশাসনের গতিশীলতা বাড়বে অবশ্যই। একই সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের স্থিতিশীলতার শঙ্কাও কাজ করবে না।

কয়েক বছর আগে, সরকার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবসরের সময়সীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়। আগে ৫৭ বছর বয়সে অবসরে গেলেও তা দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ করে। যেহেতু প্রশাসনে দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন তাই এই অবসরের সময়সীমা যৌক্তিক কারণে বাড়ানো যেতেই পারে। এর ফলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়কেন্দ্রিক প্রশ্ন অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব। প্রশাসনে দীর্ঘদিন কর্মরত কেউ সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা করেন তিনি তার অবসরের আগে শীর্ষ পর্যায় থেকেই অবসর নেবেন। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলে তাদের এই প্রত্যাশার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তা ছাড়া শূন্যপদ পূরণের ক্ষেত্রেও নানা দিক বিবেচনা করা জরুরি। কিছুদিন আগে এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখলাম, ২০১৩ সালে বিসিএস (শিক্ষা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক প্রার্থী কদিন আগে নিয়োগপত্র পেয়েছেন। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটে কিছু সমস্যা ছিল। এই সমস্যার কারণে সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনে দীর্ঘ সময় লেগেছে। প্রায় ছয় বছরের মতো এই প্রতীক্ষা ওই প্রার্থীকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। একই সঙ্গে সরকার দক্ষ একজন কর্মীর দক্ষতাকে ব্যবহার থেকে বঞ্চিতও হয়েছে। এসব বিষয় সমাধানেও কাজ করা জরুরি।

গতিশীল, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন গড়ে তোলার দাবি নতুন নয়। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের নিষ্ঠা-সততা জরুরি। প্রথমত গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত থাকার বিষয়ে তাদের সদিচ্ছা থাকা জরুরি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট না থেকে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে পারে, তা নিশ্চিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকেই। রাজনীতি সব সময় থাকবে। সরকারও বদল হতেই পারে। এই বদলের মধ্যেই প্রশাসনের কর্মীদের কাজ করে যেতে হবে। যে কেউ প্রশাসনে কাজ করলে তাকে অফিসিয়াল বলা হয়। অফিসিয়াল হওয়ার পর তার মধ্যে যেন এমন ধারণা থাকে, আমি জনগণের সেবক। কোনো ধরনের বাইরের প্রভাব যেন তার কাজকে প্রভাবিত করতে পারে না, এমন নৈতিক অবস্থান ধরে রাখা জরুরি। প্রশাসনে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। জনপ্রশাসনে কর্মরত নির্দিষ্ট কর্মীকে চেষ্টা করতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার। প্রশিক্ষণ দেওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্যও রয়েছে। প্রতিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরও চৌকস হয়ে ওঠেন। এই প্রশিক্ষণগুলো ব্যক্তির দক্ষতাও বাড়িয়ে দেয়। এই দক্ষতা ব্যবহার করে জনগণের সেবা নিশ্চিত করাই বেশি জরুরি। একজন প্রশাসনের কর্মী শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাবেন। সেজন্য সরকার সব ধরনের সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করবে। প্রশাসনের মধ্যে গতিশীলতা অনেক জরুরি।

অতীতে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ থাকায় নানা বিতর্ক ছিল। পদধারী কর্মকর্তাকে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। একজন প্রবেশন অফিসার প্রশিক্ষণ না নিলে বা প্রশিক্ষণের পর্যায় তার না পেরোলে তিনি সিনিয়র পদে উত্তীর্ণ হতে পারেন না। এক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় প্রশাসন বা বিভাগীয় প্রশাসনের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম, মণিপুরসহ ছয়টি প্রদেশে ১৩ কোটি মানুষ বসবাস করে। তার তুলনায় সামান্য বেশি জনসংখ্যাবহুল দেশ বাংলাদেশে ৮টি বিভাগ রয়েছে। এভাবে বিভাগীয় প্রশাসন না করে প্রাদেশিক প্রশাসন গড়ে তুললে ভালো হবে বলে মনে করি। প্রাদেশিক প্রশাসন শুধু গড়ে তুললেই হবে না। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণও করা জরুরি। প্রাদেশিক প্রশাসনে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্বাচিত ব্যক্তিই হবেন প্রধান। প্রাদেশিক প্রশাসনের প্রধানকে গভর্নর বলা যেতে পারে। এখানে বিভাগীয় প্রশাসকরা তাদের প্রশাসনিক দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন। জাপানে এমন পদ্ধতি রয়েছে। জনকল্যাণমুখী জনপ্রশাসন গড়ার সর্বাগ্রে দায় সরকারের। তবে একই সঙ্গে যারা জনপ্রশাসনের উপরের স্তরে থাকবেন তাদের নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে অধিক নিষ্ঠ থাকতে হবে। মাঠ প্রশাসনের যেমন উপজেলা-জেলা পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডে সরকার বিব্রত হচ্ছে, এমন বার্তা সম্প্রতি মিলেছে সংবাদমাধ্যমে। নিশ্চয়ই তা সুখকর নয়। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান হবে নির্মোহ। আমাদের দেশে এখনও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা সচল করতে পারিনি। এমনটি দুঃখজনক। প্রশাসনের গতিশীলতার স্বার্থেই আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে সমন্বয় করা যেতে পারে।

  • স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা