× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কুমুদিনী হাজং

অবিনাশী আগুনের ফুল

সিরাজুল ইসলাম আবেদ

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১৭:৫৯ পিএম

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১৮:৫৭ পিএম

নিজ বাড়ির উঠানে বসে কুমুদিনী হাজং। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের বহেরাতলা গ্রামে গত বছর তোলা। প্রবা ফাইল ফটো

নিজ বাড়ির উঠানে বসে কুমুদিনী হাজং। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের বহেরাতলা গ্রামে গত বছর তোলা। প্রবা ফাইল ফটো


কুমুদিনী হাজংকে নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের ঈদ সংখ্যা-২০২৩ এ প্রকাশিত বিশেষ লেখাটি পাঠকের জন্য পুনপ্রকাশ করা হলো। 

একদিকে দুর্বলের রক্তাক্ত পিঠে পা দিয়ে সবলের উঁচু মাথায় দাঁড়ানো, অন্যদিকে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পীড়িত-নির্যাতিত প্রাকৃতজনের লড়াই; ইতিহাসের এক অমোঘ পৌনঃপুনিক অধ্যায়। কৌমজীবন থেকে বেরিয়ে এসে সম্পদশালী হওয়ার ‘সভ্যতা’য় এর কোনো অন্ত নেই। স্থান, কালভেদে চরিত্রগুলো পাল্টে যায় মাত্র। প্রাকৃতজনের তেমনি এক সংগ্রামÑ বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা ‘টংকবিরোধী আন্দোলন’। সাধারণে ‘টংক আন্দোলন’ নামেই এর পরিচিতি। যাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র সংঘাতময়, স্বচ্ছতোয়া সোমেশ্বরীর স্রোতধারা হয়ে ওঠে রক্ত-রঙিন; তিনি কুমুদিনী হাজং। টংক আন্দোলনে যুক্ত হতে তার কোনো প্রস্তুতি বা আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন পড়েনি। ঘটনার পরম্পরা কুমুদিনীকে আন্দোলনে শরিক করেছে। ইতিহাসের অনিবার্যতা তাকে জুগিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।

প্রাকৃতজনের টিকে থাকার প্রায় শতাব্দী প্রচীন এই আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজং। নিজের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অগণন বৈরিতায় হতবিহ্বল, কিন্তু এখনও জীবিত। প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন ন্যায়ের পক্ষের যোদ্ধাদের। রোগে-তাপে-শোকে স্মৃতিপট থেকে আগুনঝরা দিনের অনেক কথা মুছে গেলেও মানসপটে এখনও অমলিন হাজংদের আদিপেশা কৃষিকাজ। মাতৃবীজ সংরক্ষণ করে এই ‘মাটির পোকা’ পরের প্রজন্মকে শিখিয়ে দেন কার্পাস বপন পদ্ধতি। 

কুমুদিনী হাজংয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ২০০৬ বা ২০০৭ সালে। নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার বহেরাতলীতে টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধে। মণিসিংহ মেলা উপলক্ষে ঢাকা থেকে অধ্যাপক এমএম আকাশ, দিবালোক সিংহসহ একটি দল মেলায় যায়। সেই দলের সঙ্গেই আমার যাওয়া। মেলায় আলোচনা মঞ্চের সামনের সারির একটি চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিলেন তিনি। ক্ষীণকায় শরীর; মুখের বলিরেখা জানান দিচ্ছিল বয়স আর অভিজ্ঞতা। পুরোটা সময় ছিলেন স্থির অবিচল। শুধু কেউ কাছে গিয়ে কুশল বিনিময়ের সময়, স্নেহময় নিঃশব্দ হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল মুখমণ্ডলজুড়ে। কখনোবা আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠছিল মলিন চোখের তারা। আলোচনা শেষে সবাই যখন এদিক-ওদিক ছুটছে, তিনি সেই চেয়ারেই চুপচাপ, কোনো ব্যস্ততা নেই। সঙ্গী আরেক নারী ছিলেন। কিন্তু টংক আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তির সঙ্গে সাক্ষাতের উত্তেজনায় তার পরিচয় আর নেওয়া হয়নি। কথায় কথায় জানতে চাই টংক অন্দোলন, হাজংমাতা রাশিমণি হাজং প্রসঙ্গে। খুব ছোট ছোট করে কথা বলছিলেন। রাশিমণির প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘মাসি তো নিজের প্রাণ দিয়ে আমাকে বাঁচায়ে দিছে। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্চে শুনে, সমিতির সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে ব্রিটিশ সেনাদের ওপর ঝাঁপায়ে পড়ে।’

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, নেত্রকোণায় কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির দিকনির্দেশনায় ১৯৪৫ সালের মধ্যভাগ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের টংক আন্দোলনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সুসং দুর্গাপুর স্কুলমাঠে সভার মধ্য দিয়ে যার সূচনা হয়। ওই সভায় পাহাড় অঞ্চল থেকে প্রায় পাঁচ হাজার হাজং নারী-পুরুষ দেশীয় অস্ত্রÑ তীর-ধনুক, দা, বল্লম নিয়ে সভায় যোগ দেয়। এই প্রস্তুতি সভার পরেই ব্রিটিশ শাসকরা আরও কঠোর অবস্থানে চলে যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। বিরিশিরির সেই ক্যাম্প থেকে তারা প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে টংক আন্দোলনকারীদের দমনের চেষ্টা চালাতে থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ বিরিশিরি থেকে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী তাণ্ডব শুরু করে। বহেরাতলীর লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই ছিল টংক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। মূলত তারাই ছিল টার্গেট। এ খবর পেয়ে তারা দ্রুত আড়াপাড়ায় মণি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যায়। 

সৈন্যরা তাদের খুঁজে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনীর কাছে বাড়ির পুরুষেরা কোথায় আছে জানতে চায়। কুমুদিনী তাদের সঠিক উত্তর না দিয়ে ‘জানি না’ বলেন। এতে সেনারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে কুমুদিনী হাজংকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। কুমুদিনীর আর্তচিৎকারে এ খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় জঙ্গি কৃষক বাহিনীর একটি সভা চলছিল। কুমুদিনীর খবর সেখানে পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ দিনের বেলা সৈন্যদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে কেউ কেউ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রাশিমণি হাজং দারুণ ক্রোধে চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘ময় তিমৗ, ময় জানি তিমৗদলৗ মান। ময় রক্ষা কুরিব না তে মরিবু। তুরা থাক তুমলৗ নীতি নিয়ৗ বুইয়ৗ থাক।’Ñ অর্থাৎ ‘আমি নারী, আমি জানি নারীর সম্ভ্রমের মান। নারীর মান আমি রক্ষা করব, নয় মরব, তোরা থাক তোদের নীতি নিয়ে।’ এ কথা বলেই রাশিমণি ছুটতে শুরু করেন। রাশিমণির সঙ্গে গিয়েছিলেন বগাউরা গ্রামের দিস্তামণি হাজং, আড়াপাড়ার বাসন্তি হাজং, রণেবালা হাজং, প্রভাবতি হাজং ও পঞ্চমণি হাজংসহ অনেকেই। তাদের পেছনে সুরেন্দ্র হাজংসহ টংক আন্দোলনের প্রায় পঁচিশজন কর্মী সঙ্গী হন। রাশিমণি হাজং শতাধিক নারী-পুরুষ নিয়ে দেশি দা, ঝাড়ু, বল্লম, লাঠি, তীর-ধনুকসহ সোমেশ্বরী নদীর তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা কুমুদিনীকে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু ফ্রন্টিয়ার বাহিনী কোনো কথা না শুনে টেনেহিঁচড়ে নববধূ কুমুদিনীকে দুর্গাপুরের সেনা ছাউনির দিকে নিয়ে চলে। রাশিমণি দা নিয়ে ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার দা-এর এলোপাতাড়ি আঘাতে একজন সৈন্য সেখানেই মারা পড়ে। সুযোগ বুঝে রাশিমণির কয়েক সঙ্গী কুমুদিনীকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কিন্তু এরপরই আরেক সৈন্যের গুলিতে হাজংমাতা রাশিমণি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুরেন্দ্র হাজংয়ের বর্শার আঘাতে প্রাণ হারায় আরেক সৈন্য। কিন্তু সুরেন্দ্র হাজংও বেঁচে ফিরতে পারেননি। প্রায় তিন ঘণ্টা চলা পাল্টাপাল্টি আক্রমণে শহীদ হন রাশিমণি হাজং ও সুরেন্দ্র হাজং।

নাতনির সঙ্গে কুমুদিনী হাজং। প্রবা ফাইল ফটো

টংক আন্দোলনের পেছনে রয়েছে হাজংদের জীবনসংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে, হাজংদের আদিনিবাস ছিল মিয়ানমারের উত্তর অঞ্চলে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হাজংদের একটি দল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় চলে আসে। সেখান থেকে আসামের কামরূপ জেলার হাজো এলাকায় এসে তারা বসবাস শুরু করে। সপ্তদশ শতকে মুঘলদের আক্রমণে হাজংরা গারো পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পরে আশপাশের সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করে। কেউ কেউ বলেন এই ‘হাজো’ শব্দ থেকেই হয়তো হাজং শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ভিন্ন মতও আছে, যারা মনে করেন ‘হাজং’ নাম গারোদের দেওয়া। অন্য পাহাড়িদের মতো হাজংরা ‘জুম’ নয়, সমতলে কৃষিকাজ করত। গারো ভাষায় ‘হা’ মানে মাটি এবং ‘জং’ মানে পোকা, অর্থাৎ গারোরা তাদের মাটির পোকা বলে ডাকত।

কৃষিই ছিল হাজংদের আদি ও একমাত্র পেশা। গারো পাহাড়ে আশ্রয় পেয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজংরা সুসং-এর জমিদারকে ‘ভগবান’ জ্ঞানে সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। সুসং জমিদার হাজংদের হাতি ধরার কাজে বাধ্য করায় একসময় তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। জমিদাররা হাজংদের দিয়ে গারো পাহাড়ের গভীরে গজারি গাছের খুঁটি দিয়ে বড় বেষ্টনী তৈরি করত। একে বলা হতো খেদা। এই খেদায় লাগানো হতো হাতির প্রিয় খাবার কলা ও ধানগাছ। গভীর বন থেকে আসা বন্যহাতির দল খাবারের লোভে খেদায় ঢুকে পড়ত। হাতির দল ঢোকামাত্র খেদার মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। এরপর পোষা কুনকি হাতির মাধ্যমে বন্যহাতি বশ করে, পায়ে শিকল পরিয়ে বাইরে নিয়ে আসত হাজংরা। জমিদাররা ওইসব হাতি ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, দিল্লিসহ বিভিন্ন জায়গার অভিজাত পরিবারে বেশ ভালো দামে বিক্রি করত। হাতি বিক্রি এই এলাকার জমিদারদের অন্যতম আয়ের উৎসে পরিণত হয়। এ কাজ করতে গিয়ে বহু হাজং চাষিকে বন্যহাতির পায়ের তলায় জীবন দিতে হয়েছিল। কিন্তু জমিদারের নির্দেশে হাজংদের বাধ্যতামূলকভাবে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এই কাজ করতে হতো। এ নিয়ে ধীরে ধীরে হাজংদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তা বিস্ফোরণে রূপ নেয় এবং এক পর্যায়ে এই অঞ্চলের জমিদারদের হাতি খেদার ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা আসে।

সরকার হাতি খেদার ক্ষমতা সুসং জমিদারদের হাত থেকে তুলে নিলে তাদের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা জমির খাজনা আদায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রচলন করে ‘টংক’ প্রথার। এ প্রথায় জমিতে কৃষকের অধিকার থাকত না। জমিদার কোনো কৃষককে জমি দিলে তার খাজনা দিতে হতো জমিতে উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে। যা নির্ধারণ করত জমিদার নিজেই। কেউ না দিতে পারলে তার ওপর নেমে আসত জবরদস্তি, নির্যাতন। সে সময়, ময়মনসিংহ জেলার উত্তরের সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবর্দীÑ এই পাঁচটি থানায় টংক প্রথা চালু ছিল। সুসং পরগনায় টংক প্রথা ছিল সবচেয়ে কঠোর। সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো ৭ থেকে ১৫ মণ। প্রতিবছর নিলামে টংকের হার নির্ধারণ করা হতো। এতে করে প্রতিবছরই টংকের হার বাড়তে থাকে। শুধু হাজংরাই নয়, ডালু ও গারো পাহাড়ের পাদদেশের সমতলের মুসলমান কৃষকরাও টংক প্রথার শিকার হয়েছিল। কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগÑ খরা, বন্যা, মড়ক কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমণ বা ভিন্ন কোনো কারণে ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষককে নির্ধারিত ধান দিতে হতো ঠিকই। তা দিতে না পারলে কৃষকদের ওপর নেমে আসত অমানুষিক অত্যাচার। বংশপরম্পরা চলতে হতো ঋণের বোঝা নিয়ে। কৃষক মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের টংক ঋণ শোধ করতে হতো। টংকের অতিমাত্রায় শোষণ গারো পাহাড় অঞ্চলের ক্ষুদ্র কৃষক, যার বেশিরভাগই ছিল হাজং; তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে একেবারেই নাজুক করে দেয়।

টংক ও কৃষক আন্দোলনের  পথিকৃৎ নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধ

এ অবস্থায় হাজং কৃষকদের ভেতরে থাকা দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ঐতিহ্য আবার দানা বাঁধতে থাকে। বিদ্রোহের সেই স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরকে রূপ নেয়; যখন সেখানে যুক্ত হয় রাজনৈতিক নির্দেশনা। এটি ঘটান সুসং জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহ। দুর্গাপুরের অদূরে কালিকাবাড়ীতে মণি সিংহ ও উপেন সান্যাল হাজংদের হাতে জল গ্রহণ, বাঙালি পুরোহিত দিয়ে পূজা করানোসহ বিভিন্ন সংস্কার এবং তাদের জন্য স্কুল তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে হাজংদের আস্থা অর্জন করেন। হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় নেতা। মণি সিংহ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই হাজংদের দলে ভেড়াতে চেয়েছেন। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবনসংগ্রাম’-এ লিখেছেন, ‘আমাদের মধ্যে একটি চিন্তা আসে যে, ব্রিটিশ সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে খতম করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে না। বিপ্লব করা দরকার, সে জন্য চাই অনেক মানুষ, জঙ্গী লোক। নচেৎ কিছু করা যাবে না।

এই চিন্তা থেকে আমরা লোক সংগ্রহ করার কাজে মন দেই। আমরা আগেই শুনেছিলাম যে, হাজং সম্প্রদায় খুব জঙ্গী। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে প্রায় চল্লিশ বছর আগে, যা ‘হাজং বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। আমি ও আমার এক সমবয়সী সন্ত্রাসবাদ বন্ধু উপেন সান্যাল ঠিক করলাম, এই হাজংদের যদি দলে টানা যায়, তবে এক চমৎকার কাজ হবে। এই চিন্তা করে আমরা দুইজনে আমাদের গ্রাম সুসং দুর্গাপুর হতে মাইল দশেক দূরে কালিকাবাড়ীতে যাওয়া স্থির করলাম। এই সময়টা হচ্ছে ১৯২৫ সালের গোড়ার দিকে।’ 

হাজংদের সঙ্গে বা টংক আন্দোলনে মণি সিংহের যুক্ততা শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ছিল না, একই সঙ্গে ছিল আত্মিক। ১৯৩৫ সালে তিনি দুর্গাপুরে আত্মগোপনে থেকে সেখানকার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। টংকর জালে জর্জরিত কৃষকের দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষ করেছেন। রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেলে আবারও দুর্গাপুরে আসেন। টংকর শোষণ তখন যেকোনো দিক থেকেই মাত্রা ছাড়া। এক আড়া বা সোয়া একরে কৃষককে টংকর ধান দিতে হচ্ছিল পনেরো মণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গারো পাহাড় এলাকার হাজং, ডালু, মুসলমানসহ সব কৃষক মণি সিংহকে অনুরোধ করেনÑ টংকবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নিতে। এ সময় মণি সিংহের যোগাযোগ হয় কলমাকান্দার লেংগুড়া গ্রামের সদ্য কারামুক্ত আদিবাসী নেতা ললিত হাজংয়ের সঙ্গে। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ততায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনিও সক্রিয়ভাবে টংক আন্দোলনে যোগ দেন। দুইয়ের মিলিত শক্তিতে দ্রুত বেশকিছু কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠে। টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব, নিরিখ মতো টংক জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি নিয়ে শুরু হয় কৃষকের অহিংস আন্দোলন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের যুক্ততায় নিঃস্ব কৃষকের গড়া টংক আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। কৃষকরা টংকর অভিশাপ থেকে বাঁচতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যুক্ত হয়। হাজংরা নিজেদের স্বার্থেই টংক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। সেই সূত্রেই কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং টংক আন্দোলনের অংশ হয়ে যান। আর যাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পায় তিনি কুমুদিনী হাজং। প্রায় শতক ছোঁয়া টংক আন্দোলনের একমাত্র জীবিত যোদ্ধা। 

নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রাম। সেই গ্রামের এক কৃষক হাজং পরিবারে কুমুদিনী হাজংয়ের জন্ম। তার বাবা অতিথ চন্দ্র ছিলেন হাতিখেদা বিদ্রোহের কর্মী। বাবার ভেতরের সেই বিদ্রোহের আগুন যে কুমুদিনীর মধ্যেও ছিল তার প্রমাণ তিনি একাধিকবার দিয়েছেন। জন্মের দুই বছরের মধ্যেই বাবা অতিথ চন্দ্র রায় হাজং ও মা জনুমণি হাজং মারা যান। চিরকুমার এক মামার আদর-যত্নে বড় হন কুমুদিনী। নিজে চিরকুমার থাকায় মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে বেহেরাতলীর মাইঝপাড়া গ্রামের দুর্গাদাস হাজংয়ের ছোট ছেলে লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে কিশোরী কুমুদিনীকে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুমুদিনীর বাবার রেখে যাওয়া চার আড়া জমি ও বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে লংকেশ্বর হাজংকে ঘরজামাই করে নেন। বিয়ের পর লংকেশ্বর তার পুরো পরিবার নিয়ে কুমুদিনীদের বাড়িতে চলে আসেন। টংক আন্দোলন শুরু হলে অন্যান্য হাজং পরিবারের মতো কুমুদিনীদের পরিবারও টংক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কুমুদিনীর স্বামীরা চার ভাই নিয়মিত আন্দোলনের সাংগঠনিক কাজে অংশ নিত। কমরেড মণি সিংহের সঙ্গেও তাদের সর্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। সে কারণেই জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর রোষানলে পড়ে পরিবারটি।

স্থানীয় উন্নয়ন কর্মী ও গবেষক ওহিদুর রহমান বলেন, ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারির লড়াইয়ের পর সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে গ্রামবাসীরা বহেরাতলীর অদূরে গভীর পাহাড় ঘেরা আড়াপাড়া অরণ্যে কমরেড মণি সিংহের গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়। পূর্ব থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও ভাসুররা। আড়াপাড়া আস্তানায় দীর্ঘ সময় শুশ্রূষার পর সন্ধ্যায় কুমুদিনী হাজং জ্ঞান ফিরে পান। কিন্তু পরের দিন ব্রিটিশ পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে তাণ্ডব চালায়। পুরো গ্রাম তছনছ করে তারা। পুলিশের গুলিতে ২২ জন হাজং কৃষক নারী-পুরুষ মারা যায়। গ্রামবাসী ভবিষ্যতে আরও বড় হামলার ভয়ে লাশগুলো সোমেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সেদিনের সেই ঘটনায় নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমণি হাজং সম্প্রদায়ের ‘হাজংমাতা’ খ্যাতি লাভ করেন আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণার উত্‍স।

সরকার এ ঘটনায় হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সরকার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলাও করে। মামলায় কমরেড মণি সিংহ, লংকেশ্বর হাজং, তার তিন ভাই ও কুমুদিনী হাজংসহ অনেক হাজং টংক আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়।

সে সময় সুসং অঞ্চলের প্রায় সকল হাজং পরিবারকেই পুলিশের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে ফেরারি জীবনযাপন করতে হয়েছিল। কুমুদিনী হাজং পুলিশের অত্যাচার ও গ্রেপ্তার এড়াতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে বলেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। কেউ যেন তাকে চিনতে না পারে সেজন্য বলেশ্বর হাজংয়ের পরামর্শে কুমুদিনী হাজংয়ের নাম পরিবর্তন করে সরস্বতী রাখা হয়। আর এ কারণেই প্রমথ গুপ্তের ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’, সুপ্রকাশ রায়ের ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক’ ও ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইয়ে কুমুদিনী হাজংয়ের নাম সরস্বতী লেখা হয়েছে।

বহেরাতলী ছাড়ার পর কুমুদিনী হাজং টংক আন্দোলনে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সে সময় তিনি হালুয়াঘাটের লক্ষ্মীকুড়াসহ আশপাশের গ্রামগুলোয় সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিরোধ আন্দোলন ও টংক প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিয়মিত হয়ে ওঠেন। সরকারের দায়ের করা হত্যা মামলা বেশ কয়েক বছর চলার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তারপরও কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও ভাসুরদের প্রায় এক বছর হাজতবাস করতে হয়। কুমুদিনী হাজং আত্মগোপন করে হাজতবাস থেকে রেহাই পান। কিন্তু কুমুদিনীদের জীবন থেকে বঞ্চনা কখনই কাটেনি। 

স্থানীয় গবেষক আলী আহম্মদ খান আইয়োব তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘বহেরাতলী গ্রামের সেদিনের ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করতে জ্যোতি বসু, ব্যারিস্টার স্নেহাংশু আচার্য ও সাংবাদিক প্রভাত দাসগুপ্ত গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আসেন। কিন্তু ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেস্টিন তাঁদের বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করতে দেননি। এতে এম.এল.এ জ্যোতি বসু বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং ‘রেইন অব টেরর ওভার দ্য হাজংস অ্যা রিপোর্ট অব দি এনকোয়ারি কমিটি’ নামে একটি নথি জওহরলাল নেহেরুর কাছে প্রেরণ করেছিলেন।’ 

তিনি লিখেছেন, ‘টংক আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কুমুদিনী হাজং ও তাঁর স্বামী টংক প্রথার বিরুদ্ধে গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজংদের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাংগঠনিক কর্ম তত্‍পরতা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের চক্রান্তমূলক আশ্বাসের ফলে সাধারণ হাজংরা নিজ নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করে। এতে আন্দোলন অনেকাংশে ভাটা পড়ে যায়। নূরুল আমীনের প্রহসনের মূল কাজ শুরু হয় পরবর্তী ১৯৬৪ সালে। সে সময় হাজংরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার থাবায় পড়ে। গ্রামে গ্রামে বাঙালী মুসলমানরা প্রবেশ করলে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সে দাঙ্গার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হাজংরা দলে দলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সুযোগে সরকারের ইন্ধনে মুসলিম সেটেলররা হাজংদের জমি বাড়িসহ সকল সম্পদ দখল করে নেয়। তেমনিভাবে কুমুদিনী হাজং-এর ৪ আড়া জমিসহ বাড়িঘর সেটেলরদের হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে সরকারের আশ্বাসে অন্যান্য হাজংদের সঙ্গে কুমুদিনী হাজং ও লংকেশ্বর হাজং দেশে ফিরে এলেও বাড়ি জমি ফেরত পাননি। সে সময় থেকেই নিঃস্ব কুমুদিনী হাজং ও তাঁর স্বামী লংকেশ্বর হাজং বহেরাতলী গ্রামের গারো পাহাড়ের বন বিভাগের একটি টিলার উপর ঘর করে বসবাস শুরু করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুমুদিনী হাজং তাঁর পরিবার নিয়ে ভারতের বাঘমারা শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে এসে শুধু ভিটে ছাড়া কোন ঘরবাড়ি পাননি। চরম দরিদ্রতায় মানুষের বাড়ি কামলা খেটে তাঁকে জীবন ধারণ করতে হয়। জরাজীর্ণ জীবনযাপন করে কুমুদিনী হাজং-এর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ২০০০ সালে মারা যান।’

দীর্ঘদিন পর আবার বিরিশিরির পথে। ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিলের পর ওই দিকে আর যাওয়াই হয়নি। এবারের গন্তব্য সরাসরি বহেরাতলী। নেত্রকোণা থেকে সঙ্গী হিসেবে যুক্ত হন স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ও গবেষক ওহিদুর রহমান, শংকর ম্রং ও স্থানীয় সমাজকর্মী রনি খান। ততদিনে অনেক বদলে গেছে এই জনপদ। ছায়াঘেরা-পাখিডাকা, নিরিবিলি সেই বিরিশিরি আর নেই। রাত-বিরাতে গভীর অন্ধকার থেকে ভেসে আসা তক্ষকের ডাক শুনতে পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। বদলে গেছে গারো পাহাড়ের পা ধুয়ে, স্বচ্ছ-শীতল ধারায় ছুটে চলা সোমেশ্বরী। এখন দিন-রাত সোমেশ্বরীর বুকে গভীর ক্ষত করে চলেছে অসংখ্য ড্রেজিং মেশিন। তোলা হচ্ছে বালু। সোমেশ্বরীর বুক থেকে পূর্বধলার জারিয়া বাজার পর্যন্ত পথÑ প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে বালুভর্তি হাজারো ট্রাক। যান্ত্রিক শব্দে চিরায়ত নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান। ওহিদ ভাই জানালেন, কয়েক বছর আগেও যে বালুমহালের ইজারা দর ছিল দুই-তিন কোটি টাকা, এখন তা শতকোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে। তাই প্রতিমূল্য তো কিছু গুনতেই হবে। কিন্তু এলাকার যে কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য বদলের জন্য কয়েকশ বছর সংগ্রাম করেছেন তাদের ভাগ্য কি বদলেছে? 

প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে আমরা এগিয়ে চলি টংক আন্দোলনের শেষ সাক্ষী কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে থামতে হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ‘রাশিমণি হাজং স্মৃতিসৌধ’। যে অস্ত্র দিয়ে টংক যোদ্ধারা লাড়াই করেছে, সেই তীর-ধনুকের আদলে সৌধটি। ধনুকের ছিলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তীর। প্রয়াত কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের নকশায় টংক আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে সৌধটির নির্মাণ করেছে হাজংমাতা রাশিমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। সেখানে দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করি, চেনে নাকি কুমুদিনী হাজংকে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলেনি উত্তর।

দুই মোটরবাইকে আমরা চারজন আবার যাত্রা করি। একটু সামনে এগিয়েই মূল রাস্তা থেকে সরু পথ নেমে গেছে। কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়ির টিলার গোড়ায় গিয়ে আমরা থামি। এখানেই কুমুদিনী হাজং থাকেন তার দ্বিতীয় ছেলে অর্জুন হাজংয়ের সঙ্গে। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রমেন্দ্র হাজং সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করেন। দ্বিতীয় ছেলে অর্জুন হাজং দিনমজুর। তৃতীয় ছেলে সহদেব হাজং ১৯৭৫ সালে দেশের পটপরিবর্তনের পর কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। পরে কাদের সিদ্দিকীসহ তার সঙ্গীরা দেশে ফিরে এলেও তিনি ভারতেই থেকে যান। কুমুদিনীর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। ছোট মেয়ে অঞ্জলি কমরেড মণি সিংহের ছেলে দিবালোক সিংহের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা ডিএসকে-তে চাকরি করেন। টিলা বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়েÑ বাড়ির সামনে একটু ছায়ায় মাটির ওপর হাঁটুমুড়ে বসে আছেন কুমুদিনী হাজং। উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন দূরে কোথাও। বয়সের ভার আর অর্থনৈতিক দৈন্যে একেবারেই জবুথবু অবস্থা। কে বলবেÑ এই মানুষটি একদিন জমিদার আর ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সরকারের রোষানলে ঘর ছেড়েছেন, ছেড়েছেন গ্রাম। কখনও ছাড়তে হয়েছে দেশ। কিন্তু আপস করেননি। আন্দোলন সংগঠিত করতে রাত-বিরাতে ঘুরেছেন বনে-জঙ্গলে। 

আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ব্যস্ত হয়ে ডাকতে থাকেন নাতনি হ্যাপি হাজংকে। আমরা পরিচয় দিই। চেনার কোনো কারণ নেই আমাদের, আমাকে তো নয়ই। তারপরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে। নাতনিকে আমাদের জন্য চেয়ার দিতে বলেন, নিজে বসলেন মাটিতে। হ্যাপি জানায়, ‘দাদি এখন কাউকে চিনতে পারেন না, আগের কিছু বলতেও পারেন না। কিন্তু বাড়িতে যে-ই আসুক তাকে নিয়ে এ রকম ব্যস্ত হয়ে পড়েন।’ আমাদের সঙ্গেও তার কথা হলো খুবই কম। টংক আন্দোলনের কথা জিজ্ঞেস করলে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকান। কখনও একেবারে চুপ হয়ে যান। এক সময় দুই হাত জোড় করে কিছুটা অস্পষ্ট স্বরে টেনে টেনে বললেন, ‘সবাই চলে গেছে, শুধু আমিই এহেনও আছি…।’ আরেকবার জানালেন তার শারীরিক সমস্যার কথাÑ ‘চোখে দেহি না, কানে শুনি না, মাথা ঘুরায়…।’ আমরা আর তাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তার পাশে বসে থেকে হ্যাপির সঙ্গে গল্প করি। 

সোমেশ্বরী নদী

হ্যাপি আর অরণ্য দুই ভাইবোন মিলে বিভিন্ন সময় কুমুদিনীর পাওয়া সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট দেখায়। ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির সংগ্রামে অবদানের জন্য কুমুদিনী হাজংকে অনন্যা শীর্ষদশ, ২০০৩ (আন্দোলন) নির্বাচিত করে। আনুষ্ঠানিকভাবে সাপ্তাহিক অনন্যা কুমুদিনী হাজংকে একটি ক্রেস্ট ও নগদ পনেরো হাজার টাকা প্রদান করে। এ ছাড়া তাকে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে দেয়। ২০০৫ সালে স্বদেশ চিন্তা সংঘ কুমুদিনী হাজংকে ‘ড. আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার’ প্রদান করে।

কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি ময়মনসিংহ ১৯৯৬ সালে সংবর্ধনা প্রদান করেছিল, সেই ক্রেস্ট-মানপত্র দেখায় তারা। সিধু কানহু ফুলমণি পদক-২০১০, জলসিঁড়ি পদক-২০১৪, হাজং জাতীয় পুরস্কার-২০১৮, নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কর্তৃক সম্মাননা স্মারক-২০২১ ঘরে সাজানো। 

ছেলে অর্জুন ও ছেলে বউ আর্মিলা হাজং তখন মাটি কাটার কাজে বাড়ির বাইরে। বড় নাতনি লিপি হাজং ময়মনসিংহে নার্সিং কলেজে পড়ছে। স্থানীয় কলেজে এইচএসসি শিক্ষার্থী হ্যাপি আর তার একমাত্র ভাই অরণ্য হাজং পড়ছে দশম শ্রেণিতে। কুমুদিনীর সংসার চলে ছেলে ও ছেলে বউয়ের দিনমজুর আর তার পাওয়া বয়স্ক ভাতা দিয়ে। এক সময় নাতনিকে বলেন কার্পাস তুলার বীজ আনতে। হ্যাপি ছোট একটা পোঁটলায় তুলে রাখা কিছু বীজ কুমুদিনীর হাতে দেয়। পোঁটলা খুলে সেই বীজ আমাদের সঙ্গী শংকর ম্রংয়ের হাতে তুলে দিয়ে দেখাতে থাকেন কীভাবে লাগাতে হবে। মুখে বলেন, ‘একটা গর্তে দুইটা’ অর্থাৎ একটা গর্তে দুইটা করে বীজ লাগাতে হবে। বিস্মিত হয়ে ভাবি, অতীতের সব স্মৃতিই হারিয়ে গেলেও কীভাবে গাছ লাগানোর বিষয়টা ঠিক মনে আছে! কিন্তু তখনও জানতাম না অবাক হওয়ার আরও আছে বাকি। আমাদের বসিয়ে রেখেই হ্যাপি কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তার তৈরি হওয়া দেখে কুমুদিনী হাজং বলে ওঠেন, ‘সমিতি যায়’, হ্যাপি হেসে উঠে আমাদের ব্যাখ্যা করে, কলেজকে দাদি সমিতি বলে। যেই কৃষক সমিতি বদলে দিয়েছে কুমুদিনীর জীবন, তা এখনও বহন করে চলেছেন!

মাটির দাওয়ায় আবারও উদাস হয়ে বসে রইলেন কুমুদিনী হাজং। একসময় উঠতে হলো। আমরা বিদায় নিচ্ছি। তার মুখের খুব কাছে দিয়ে বাতাসে দুলছিল লাল রঙের বাগানবিলাস। দুই হাত মাথার ওপর তুলে প্রণামের ভঙ্গিতে বসে রইলেন। হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ উঁকি দেয়। কুমুদিনী হাজং সত্যিই কি অতীতের সব কিছু ভুলে গেছেন, না-কি বলতে চান না? ভুলে যাওয়া এই সমাজকে, রাষ্ট্রকে সেই একই কথা বারবার বলে কী লাভ? কেউ তো মনে রাখে না। ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তান গেছে, বাংলাদেশও পেরিয়ে গেছে ৫০ বছর। তাদের জীবনে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? হ্যাপি বলছিল, ‘তার দাদি রাতে এমনি করে আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার রাতের তারা দেখেন।’ একদিন রাতের অন্ধকারে যেই তারা দেখে পথ চিনে নিতেন, আজও হয়তো সেই তারার দিকে চেয়ে অতীতে ফিরে যান। কে বলতে পারে?

দূরে একটা শিমুল গাছ। সব গাছ ছাড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটাও পাতা নেই। শুধু ফুল আর ফুল- টকটকে লাল; যেন আগুনের ফুল। শিমুল গাছটাকে হঠাৎই কুমুদিনী হাজং মনে হয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা