স্বাধীনতার মাস
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫৯ এএম
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ভুট্টো একটি বই লেখেন ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’
নাম দিয়ে; সে-বইতে মহাবিজ্ঞের মতো তিনি বলেন, তিনি আশা করেন সেনাবাহিনীর লোকেরা
আওয়ামী লীগের শহুরে সদস্যদের নিরস্ত্র করার মধ্যেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ
রেখেছে, গ্রামের মানুষকে ঘাঁটায়নি; কেননা ঘাঁটালে সত্যিকারের বিপদ ঘটবে। তিনি
জানতেন না যে, সামরিক বাহিনীর পক্ষে গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার না করে উপায় ছিল
না, কারণ শহর-গ্রাম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ তখন হানাদারদের বিরুদ্ধে এক
হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হানাদাররা অবশ্য কোনো তত্ত্বের পরোয়া করেনি, তারা সরাসরি
গণহত্যায় নেমে পড়েছিল।
ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ যখন চলছিল, তখন ভুট্টোর সঙ্গে
মুজিবের একবার দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনেই। মুজিব তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে
বলেছিলেন, ‘এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাকি নাটকীয়ভাবে
জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব, তবু ইতিহাসের হাতে মরব না।’ এ খবর
তিনি জানিয়েছেন আমাদের, তাঁর ওই বইয়ের মারফত। তা ইতিহাসের জন্য অপেক্ষা করার দরকার
পড়েনি, সেনাবাহিনীর হাতেই তো তিনি প্রাণ দিলেন। সেনাবাহিনী কিন্তু শেখ মুজিবের
গায়ে হাত দিতে পারেনি, তাদের উৎকণ্ঠা ছিল তাঁকে জীবিত অবস্থায় বন্দি করে
পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে। নিতে পেরেছিল দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল,
কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো ততদিনে ভেঙে গেছে।
২৬ মার্চ পাকিস্তানের মৃত্যু দিবস বৈকি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২৬ মার্চ
করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানকে
বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। সেদিন ভুট্টো কি সত্যি সত্যি ভেবেছিলেন যে, গণহত্যা
পাকিস্তানকে বাঁচাবে, নাকি তিনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন?
ভেবেছিলেন কি যে ওই রকমের একটি আওয়াজ না দিলে তাঁকেও ওই ভগ্নস্তূপে নিক্ষেপ করা
হবে? নাকি তিনি ইতিহাসজ্ঞান ও বাস্তব বুদ্ধি দুটোই হারিয়ে ফেলেছিলেনÑ ক্ষমতার
লোভে? তবে তিনি যে অস্থিরচিত্ত এক জুয়াড়ি ছিলেন তা মোটেই মিথ্যে নয়। অপরিণামদর্শী
ও ক্ষমতাভোগী সেনাকর্তাদের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে তিনি যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে হাত
মেলাতেন, তবে ইতিহাস কোন গতিপথ বেছে নিত আমরা জানি না, তবে যে গতিপথে এগোচ্ছিল
সেটি ধরে হয়তো এগোতো না।
ভুট্টো প্রতারণা কিছু কম করেননি। পঁয়ষট্টিতে আইয়ুব খানকে তিনি উস্কানি
দিয়েছেন যুদ্ধে নামতে, অভিসন্ধি ছিল তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় কি-না সেটা দেখা।
একাত্তরে ইয়াহিয়া খানকেও একই উস্কানি দিয়েছেন, একই অভিসন্ধির তাড়নায়। বলেছিলেন চীন
থেকে সাহায্য এনে দেবেন। চীনে গিয়েছিলেনও, কিন্তু যুদ্ধ বাধলে চীন তাতে ঝাঁপিয়ে
পড়বেÑ এমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাননি এবং পাননি যে সে-কথাও ইয়াহিয়াকে জানাননি।
পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান নিয়াজী তো চীন আসবে আসবে করতে করতেই শেষ হয়ে গেলেন।
ইয়াহিয়া তখন সর্বশক্তিমান; কিন্তু তিনিও যে স্বাধীন ছিলেন এমন নয়। তাঁর চারপাশে
যেসব বাজপাখি ওত পেতে বসেছিল তাঁদের সম্মতির বাইরে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এমন ক্ষমতা
তাঁর ছিল না। কোনো কোনো জেনারেলের সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টোর যে ঘনিষ্ঠতা ছিল
এ-খবরও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতালিপ্সায় জাতীয়তাবাদী ভুট্টো তখন চরমপন্থি।
এক পর্যায়ে তো শেখ মুজিবকে বলেই ছিলেন যে, ‘তুম উধার আম ইধার’। ভাবটা অনেকটা ১৯৪৬-৪৭-এ অখণ্ড বাংলার হিন্দু
মহাসভাপন্থিদের মতো; ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় যাঁরা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে
দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্ষমতাই যদি না থাকল তা হলে তাতে দেশে থাকলেই-বা কি
না-থাকলেই-বা কি।
শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন তাঁকে
শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না এবং হুঙ্কার দিয়েছিলেন এক ইঞ্চি ভূমিও ছেড়ে দেওয়া হবে
না। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই করতে পারলেন না; হামুদুর রহমান কমিশন তাঁর ব্যাপারে
তদন্ত করল, তাঁকে কোর্ট মার্শাল করা দরকার বলে জানাল, কিন্তু কোর্ট মার্শাল হলো
না, সেনাবাহিনীর চাপেই হবে। তা ছাড়া ক্ষমতায় এসে ভুট্টো তখন নানা ধান্দায় ব্যস্ত
আছেন, ভারতে আটক ৯০ হাজার সৈনিক ফেরত আনা, বাংলাদেশ যে ১৯৫ জনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত
করে বিচারের জন্য ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে তাদের রক্ষা করাÑ এসবের মোকাবিলা
করা সহজ ছিল না। ইয়াহিয়া ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচার করতে গেলে ভুট্টোর নিজের
সংশ্লিষ্টতাও বেরিয়ে পড়বে, এমন ভয়ও যে ছিল না তা তো নয়। খুবই ছিল। ইয়াহিয়া খানরা
তাই বিচারের হাত থেকে বেঁচে গেলেন, নইলে শেখ মুজিবের পরিবর্তে তাঁরাই
রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হতেন। কারণ আঘাত তাঁরাই প্রথমে করেছেন এবং তার
প্রতিক্রিয়াতে রাষ্ট্র ভেঙে গেছে। বোঝা গেছে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ জিনিসটা কেমন
কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক ছিল এবং তার সশস্ত্র রক্ষকরা কতটা অন্ধ, মূর্খ ও হৃদয়হীন
ছিল। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণিপাকে পড়ে সাতচল্লিশে কত মানুষ যে চরম দুর্ভোগ
সহ্য করেছে তার হিসাব নেই; একাত্তরে তারই প্রকোপে আবার কতজন কী যন্ত্রণা সহ্য করল
তারও হিসাব করা সম্ভব হবে না।
পাকিস্তান এক জাতির রাষ্ট্র ছিল না। সে-রাষ্ট্রে বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি,
পাঠান, বেলুচ, মোহাজের- এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা ছিল, তাদের
দলিতমথিত করে এক জাতিতে পরিণত করা ছিল অসম্ভব কর্ম। করতে গেলে যেসব বিপদ ঘটা সম্ভব
তার সবকটিই ঘটেছিল একাত্তরে, পূর্ববঙ্গে তো বটেই পশ্চিম পাকিস্তানেও। যুদ্ধশেষে
যে-বাংলাদেশ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি সেটাও কিন্তু এক জাতির দেশ নয়। এখানে অন্য
জাতিসত্তাও রয়েছে, তা তারা সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন। ভোলা অন্যায় হবে যে,
আমাদের রাষ্ট্র জাতি-রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; এ যুগে এক জাতি এক রাষ্ট্র
এমন বিন্যাস আর সম্ভবপর নয়। তবে পূর্ব যে পশ্চিম থেকে আলাদা হবেÑ এটা অনিবার্য
ছিল। তার কারণগুলো আমরা জানি। ভৌগোলিক দূরত্ব, এককেন্দ্রিক শাসন, কেন্দ্রের শোষণ,
নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য, এসব কারণ মোটেই অপ্রত্যক্ষ ছিল না। কিন্তু জাতীয়তার
প্রশ্নটিও যে নির্ধারকের ভূমিকাতে ছিল সেটা যেন না ভুলি। অবিভক্ত বঙ্গে শোষিত
বাঙালি মুসলমান নিজের মুসলমান পরিচয়টি প্রধান হিসেবে দেখতে পেয়েছে, কেননা স্থানীয়
শোষক হিসেবে যারা দৃশ্যমান ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। সেটাই ছিল কৃত্রিম
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তৈরির ভিত্তি। ওটিকে তৈরি করা বিশেষভাবে দরকার হয়ে পড়েছিল
শ্রেণিচেতনাকে দমিয়ে রাখার জন্য। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বাঙালি মুসলমান দেখল যে,
সে শোষিত হচ্ছে একদল মুসলমানের দ্বারা, যারা অবাঙালি; তখন তার ভেতর যে চেতনাটি বড়
হয়ে দেখা দিল সেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ওটি সব সময়েই ছিল, বলা যায় সুপ্ত না-থেকে
আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল।
সত্তরের নির্বাচনে ‘পূর্ববঙ্গ শ্মশান কেন’Ñ এই প্রশ্ন তুলে বৈষম্যের যে তথ্যচিত্র
প্রদর্শন করা হয়েছিল, তা ভোটারদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু চূড়ান্ত
হিসাবনিকাশে জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নটিই ছিল নির্ধারক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধ জেগে
উঠেছিল এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে তার মীমাংসা সম্ভব ছিল না।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সে-কথাটাই জানিয়ে দিচ্ছিল। এটা বললে তাই অসংগত হবে
না যে, জাতি প্রশ্নের মীমাংসার প্রয়োজনীয়তাতেই বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে হয়েছে।
ব্যাপারটা স্মরণ করা জরুরি এই জন্য যে, একে সাধারণত অবজ্ঞা করা হয়। একটি দৃষ্টান্ত
দেওয়া অবান্তর হবে না। দুই অর্থনীতির জোরালো প্রবক্তা ছিলেন অধ্যাপক রেহমান
সোবহান। তাঁর ওই সময়ের লেখার সংকলন করে একটি বই বের হয়েছে যেটির তিনি নাম রেখেছেন,
‘ফ্রম টু ইকোনমি টু টু নেশনস’। ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক ওই রকমের নয়। প্রথমত, দুই ইকোনমি
দুই নেশনের জন্ম দেয়নি, বাঙালির একটি স্বতন্ত্র নেশন আগেও ছিল, ঐতিহাসিকভাবেই ছিল,
যে-জ্ঞান ঘা খেয়ে জেগে উঠেছে মাত্র। দ্বিতীয়ত, একাত্তরে বাঙালিরা নিজেদের রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ পাঁচটি স্বতন্ত্র
জাতিসত্তা যে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তা তো নয়।
জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা আছে। হিটলার মুসোলিনী খুব বড়মাপের জাতীয়তাবাদী ছিলেন। আগ্রাসী হলে সে জাতীয়তাবাদ কতটা যে নৃশংস হতে পারে আমাদের দেশে একাত্তরের হানাদাররা তার নতুন জ্বলন্ত প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে জাতিগত পরিচয় যে নিছক কল্পনার ব্যাপার নয় এরও প্রমাণ বাঙালিরা দিয়েছে একাত্তরে। ইতিহাসে দুই-ই আছে এবং কোনোটিই উপেক্ষার নয়। এই পরিচয় গড়ে ওঠে ভাষা, অর্থনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, সামাজিকভাবে পাশাপাশি বাস করার অভিজ্ঞতা, সবকিছুর বাস্তবিক সংমিশ্রণে। আশ্রয় দেয়, একাত্তরে যেমন দিয়েছিল বাঙালিদের। জাতীয়তাবাদ আবার পারে আহত বণ্য প্রাণীর মতো হিংস্র হতে, ওই সময়ে যেমনটা হয়েছিল হানাদার পাকিস্তানিদের জাতীয়তাবাদ।