স্বাধীনতার মাস
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪ ১০:০৮ এএম
মোস্তফা হোসেইন
যুদ্ধের ক্ষত দুরারোগ্য, কয়েক প্রজন্ম ধরে চেষ্টার পরও যেন শুকায়
না। জয় কিংবা পরাজয় যা-ই হোক না স্থায়ী দাগ ফেলবেই যুদ্ধের ক্ষত। আমাদেরও ফেলেছে একাত্তরে
মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বে। সম্পদ হারানোর যে ক্ষয়ক্ষতি তা হয়তো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে,
স্বজন হারানোর ব্যথাটাও অধিকাংশই মনের আড়ালে চলে গেছে; কিন্তু যে মানুষগুলো পাকিস্তানি
হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আঘাতে হাত-পা কিংবা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়েছেন, যে মানুষগুলো দীর্ঘদিন বেঁচেছিলেন কিংবা এখনও বেঁচে আছেন তাদের
অবস্থাটা কী? হানাদারদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে কিংবা বোমার আঘাতে যেসব সাধারণ
মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জীবনযন্ত্রণা কত দুঃসহ তা বর্ণনাতীত। রাষ্ট্র-সরকার
তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু এককালীন অর্থ সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু
এরপর তাদের দিকে সেভাবে তাকানো হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকার ভাতা প্রদানসহ
হীতকর অনেক কিছু করেছে তা সত্য। কিন্তু এই মানুষগুলো যেহেতু সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা
তালিকাভুক্ত নন যেহেতু সরকারি কোনো সহযোগিতাই তারা পান না।
একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখিত মানুষগুলোর ক্ষেত্রে কোনোটাই হচ্ছে
না। শত শত এমন মানুষ এখনও লড়াই করছেন বেঁচে থাকার জন্য। তাদেরই একজন হামদু মিয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
কসবা উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত এলাকার একটি গ্রাম চক চন্দ্রপুর। একাত্তরে যোগাযোগব্যবস্থা
আজকের মতো ছিল না। গ্রাম হিসেবে ওই গ্রামটি এমন খ্যাত কিছু নয় যে, পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনীর গ্রামটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছিল। অন্যদিকে সীমান্ত লাগোয়া
গ্রামটি এমনিতেই অধিক নিরাপদ ছিল। কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃষ্টিসীমায় ছিল
গ্রামটি। আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার বেড়ে গেলেও চক চন্দ্রপুর
গ্রামের মানুষ অনেকেই বাড়িতেই থেকে যায় শুধু ওই কারণে। ওই গ্রামের বাদশাহ মিয়ার ছেলে
হামদু মিয়াও ছিলেন নিজ বাড়িতে। যখনই আওয়াজ হতো ‘পাঞ্জাবি আইয়েরে’ তখনই দৌড়ে পালাতেন পুবের পাহাড়ে
ভারতের গ্রামগুলোতে। পাকিস্তানিরা কসবা এলাকা থেকে মর্টার শেল মারত। সেগুলো কখনও কখনও
ভারতীয় এলাকায় গিয়েও পড়ত। সুতরাং সীমান্তের ওপারে ভারতীয় গ্রামগুলোতে অবস্থানকারী শরণার্থীরাও
যে নিরাপদে ছিলেন তা বলা যায় না। হামদু মিয়াদের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম আসে
একাত্তরের মে মাসের দিকে। হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি থেকে রক্ষা পেতে এলাকাবাসী দৌড়ে
ভারতীয় এলাকায় ঢুকে যেতেন এবং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়কারীরা পাকিস্তানিদের বোমার আঘাত
থেকে বাঁচতে গিয়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতেন।
হামদু মিয়ার পরিবারের সদস্য ছিলেন হেবজু মিয়া। হেবজু মিয়া একবার চার
আনায় একটা কাঁঠাল কিনে আনেন। পরিবারের সবাই ওই কাঁঠাল খেয়ে ক্ষুধা মিটিয়েছিলেন। কাঁঠালের
বিচিগুলো পরে সেদ্ধ করে ভাতের পরিবর্তে খেয়েছিলেন, তাও জেনেছি গবেষণা কাজের জন্য ওই
অঞ্চলে অনুসন্ধানে গিয়ে। একসময় তারা সীমান্তবর্তী গ্রামে দেখা পান বজেন্দ্রবাবুর। তিনি
ছিলেন হামদু মিয়ার বাবার শৈশবের বন্ধু। বন্ধুর দুর্দিনে বন্ধু এগিয়ে আসেন। হামদু মিয়াদের
থাকার জন্য তার বৈঠক ঘরটি ছেড়ে দেন। এ ছাড়াও তার মালিকানাধীন পাহাড়ের বিশাল অংশে শরণার্থীদের
আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, দুয়েক বেলা খাবারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন বজেন্দ্রবাবু।
অনুসন্ধানে এও জানি, হামদু মিয়াদের বাড়ি সীমান্তসংলগ্ন হওয়ার কারণে তারা তখন প্রায়ই
সুযোগ বুঝে বাড়ি আসতেন। বাড়িঘর ঠিক আছে কি না, দেখে যেতেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের
আগে একদিন রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশে। সঙ্গে ছিলেন হেবজু মিয়ার বাবা। পাহাড়ি এলাকা কালাপানিয়ায়
পৌছে তারা টের পেলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কসবা থেকে একের পর এক বোমা বর্ষণ করছে।
এ জন্য তাদের তখন আর নিজ গ্রামে যাওয়া সম্ভব হলো না। তারিখ মনে নেই। তারা আবার শরণার্থী
শিবিরে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। কালাপানিয়ার হাঁটাপথ সরু। সেই পথেই ফিরতে হবে। একেবারে
পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা। অনুসন্ধানকালে আলাপেই এসব জেনেছিলাম। এও জেনেছিলাম, কিছু
দূর যেতেই ঘটল বিপর্যয়। পাহাড়ের নিচের রাস্তায় কখন পাকিস্তানিরা মাইন পুঁতে রেখে গেছে
কেউ জানে না। ওই মাইনে পায়ের স্পর্শ লাগতেই বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয়। মাইনের আঘাতে
হামদু মিয়ার একটি পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রক্ত ঝরছে। এই রক্ত বন্ধ করতে না
পারলে তিনি রক্তশূন্যতায়ই মারা যেতে পারেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সবাই। তিনি ওখানেই পড়ে
থাকেন।
সঙ্গীরা তাড়াতাড়ি বজেন্দ্রবাবুর বাড়ি চলে যান। সেখান থেকে একটি দরজার
পাল্লা নিয়ে আসেন তারা। বজেন্দ্রবাবুসহ অন্যরা তাকে দ্রুত আগরতলা জিবি হাসপাতালে নিয়ে
ভর্তির ব্যবস্থা করেন। তখন চিকিৎসারত ওই হাসপাতালে রোগীদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের।
ভারতীয় অনেককেও দেখতে পেলেন। তারা তাকে দেখতে এসেছে। এই মানুষগুলো একসময় বাংলাদেশের
অধিবাসী ছিল। সাম্প্রদায়িকতার কারণে ভারতে চলে আসে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে। সেই
মাটির মানুষের বিপদে তাদের এই মানবিক সহযোগিতার কথা তিনি ভুলতে পারেন না। দীর্ঘ তিন
মাস তার চিকিৎসা চলে আগরতলা জিবি হাসপাতালে। ওখানকার চিকিৎসকরা আসলে চাকরি নয়, মানবিক
সহযোগিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবা করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্বজুড়ে নানাভাবে প্রতিবেশি
ভারত সরকার তো বটেই নানা স্তরের, বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষও এই ভূখণ্ড থেকে যাওয়া
বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবিক তাগিদে।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বছর খানেকের মধ্যে বিয়ে করেন হামদু মিয়া। চার মেয়ে ও তিন ছেলের সংসার তার। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পার করে দিয়েছেন এক পায়ের ওপর ভর করে। মাঝেমধ্যেই হামদু মিয়ার মনে হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে একাত্তরের ডিসেম্বরে, আর এরপর শুরু হয় তাঁর যুদ্ধ। যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন হামদু মিয়াকে দুঃসহ জীবনযুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে। এ যে নিরন্তর লড়াই। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ২ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ তাকাননি তাদের দিকে। এখন আর তার চলছে না। রাষ্ট্রশক্তি হামদু মিয়াদের দিকে হাত বাড়াবে এটাই প্রত্যাশা।