× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মূল্যস্ফীতি

সিন্ডিকেটের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪ ১০:১২ এএম

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৩ এবং তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দেয়। যদিও খাদ্য সংকটের বিষয়টিকে এখন অনেকাংশে অবান্তর মনে হচ্ছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি পরোক্ষভাবে খাদ্য সংকটের বিষয়টি সামনে তুলে ধরে। চলছে পবিত্র রমজান মাস। রমজানের আগে বাজারে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি যে বাস্তবায়িত হয়নি, তার প্রমাণ সংবাদমাধ্যমে ভোক্তার অভিযোগে প্রতিনিয়ত মিলছে। আমরা জানি, বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তির ওপর। পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। কোনো পণ্যের চাহিদা অনেক কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে দাম বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে দাম বাড়ে। কিন্তু আমরা দেখছি, আমাদের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিই বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। আইনের হাতের চেয়েও কি সিন্ডিকেটের হাত লম্বা, এমন প্রশ্ন ফিরে ফিরে উঠছে।


কোভিড মহামারিকালে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছিল। তবে তাও সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ক্ষেত্রেই সত্য। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কিছু খাদ্যশস্য বা বৈদেশিক পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছিল। অথচ আমরা দেখেছি, মহামারি কিংবা যুদ্ধের অজুহাতে মুনাফালোভী কতিপয় ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা সরকারের দায়িত্বশীলরাও স্বীকার করেন কিন্তু এর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত হয় না কেনএ প্রশ্ন নতুন নয়। অর্থনীতির সূত্রানুসারে যে কয়েকটি বিষয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে, এই সূত্র দেশে অনুসৃত হয় না। কারণ নিয়ন্ত্রক বা তদারকি সংস্থাগুলো এখনও শক্তিশালী নয়। শুধু তাই নয়, তদারকি সংস্থাগুলোর যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তারও পূর্ণ বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় না। দেশে পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে জোগান, চাহিদা ও উৎপাদন খরচের বাইরে আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। বাজারে সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। সিন্ডিকেট একটি সংগঠিত চক্র, যারা বাজারকে প্রভাবিত করে এবং সিন্ডিকেটের হোতারা ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে সরকারের কঠোর হুশিয়ারি সত্ত্বেও।

সিন্ডিকেটের হোতারা নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। বাজারে যেকোনো অপতৎপরতাকারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। কিন্তু  এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা তখনই কার্যকর হবে যখন বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর কাছে পণ্যের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে উদ্যোগ যেমন নেই, তেমন সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই অক্ষমতাকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেট গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। আমাদের অর্থনীতি্র আকার অনেক বড় হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা একটি ভুল যুক্তি উপস্থাপন করি এবং তা হলো দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। অর্থনীতির আকার বড় হতে শুরু করলে মানুষের আয় বাড়বে, এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা মুদ্রার ওপিঠটুকুও দেখতে রাজি নই। আয়ের বিপরীতে মানুষের ব্যয়ভার বেড়েছে। আমরা বলছি, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। ফলে পরিবহন খরচ কমছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মুনাফালোভ যে কমেনি আমাদের বাজার পরিস্থিতি এরই সাক্ষ্যবহ। দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়, এই অভিযোগ নতুন নয়। অসংগঠিত বাজার ব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, চাহিদার সঙ্গে সরবরাহ শিকলে কোনো বিঘ্ন না ঘটলেও রমজানে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়।

আমরা জানি, রমজানে বাড়তি চাহিদা রয়েছে এমন ভোগ্যপণ্য অনেক আগেই আমদানি করা হয় যেন ভোক্তার দুর্ভোগ না হয় এবং এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, এবার রমজান মাসে ভোক্তার চাহিদার কথা বিবেচনা করে রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ছোলা, ভোজ্য তেল, চিনি ও মসুর ডাল আমদানি করে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়েছে। সেই নিরিখে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, এরপরও ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলালেই ভোক্তার দুর্ভোগের নানা চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসে। রমজানের শুরুতে খেজুরের অসহনীয় দাম নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। চাল, ডাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাদে মাংসের বাজারেও একই অবস্থা। আমরা দেখছি, পিস হিসেবে কিনে আনা তরমুজ বিক্রি করা হচ্ছে কেজি দরে। বাজারে নিয়ন্ত্রণহীনতার এও অন্যতম বড় নজির।

বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, যেমনটি এবার রোজা শুরুর আগেই খেজুরের ক্ষেত্রে হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনেছেন এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাধ্য হয়েই ভোক্তাকে এসব পণ্য কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হয়। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। স্বাভাবিকভাবেই বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বলা হয়ে থাকে। গত কয়েক বছর যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু অজুহাত। অতি সাম্প্রতিক অজুহাত হচ্ছে বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকট। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়তে পারে, কিন্তু ডলারের সংশ্লিষ্টতা নেই এমন পণ্যের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে কেন, এ প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।

দেশে উৎপাদিত চার পণ্যÑ দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, আলু ও মোটা চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লেখিত চার পণ্যের দাম তিন বছরের ব্যবধানে ২০ থেকে ২২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রামনির্ভর। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হয়, প্রাথমিক কৃষিপণ্যগুলোর বিক্রয়মূল্য শহরের তুলনায় গ্রামে কম হবে, কিন্তু বাস্তবতা একেবারে উল্টো। কারণ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে মজুদদারদের কারসাজি আছে। আলুর মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বাজারে আলুর উচ্চমূল্যের পেছনে হিমাগার মালিকদের কারসাজি রয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতির জন্য চাহিদা ও সরবরাহ দুটি কারণই দায়ী। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আমদানি ঠিক রেখে সাপ্লাই চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। রমজানের আগেই সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্নের কথা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা ছিলেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন থাকলেও ভোক্তার কাছে পণ্যের বিক্রয় প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের অভাব থাকে।

ভোক্তার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কোন পণ্য কত দামে বিক্রি হবে, কেন দাম বেড়েছেÑ এর যথোপযুক্ত যুক্তি ভোক্তাকে দেওয়া হয় না। ভোক্তা বাজারে যান এবং গিয়ে আচমকা শুনতে পান পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। রমজান মাসে মানুষের খাদ্যব্যয় বাড়ে। এর মানে এই নয় মানুষ বেশি খায়। রমজান মাসের আয়োজনে কিছু নিত্যপণ্য বাড়তি ক্রয় করতে হয়। সারা বছর ছোলা, মুড়ি, গুড়, চিড়া, বেসনের যে চাহিদা থাকে, রমজান মাসে তা একটু বেড়ে যায়। ইফতারে এ কয়েকটি পণ্য প্রয়োজন। মূলত চাহিদা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি করতে না পারার সুযোগটিকে কাজে লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে বাজারে প্রকৃত চাহিদা নিরূপণের বিকল্প নেই। প্রকৃত চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির সঠিক তথ্য নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ নিয়ে অতীতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর করা যায়নি। তবে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে চাহিদা নিরূপণ ও বাজারে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।

মূল্যস্ফীতির অভিঘাত এখন আর শুধু নিম্ন আয়ের বা নিম্নবিত্তদেরই কাবু করেনি, সব শ্রেণী-পেশার মানুষই যাপিত জীবনে চাহিদার তালিকা কাটছাট করতে বাধ্য হচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সামলাতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থাপনার স্তরে স্তরে যে ত্রুটি রয়েছে সেদিকে নজর দেয়া। পণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়ে যে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সামলানো যাচ্ছে না, তা তো ইতোমধ্যে প্রতীয়মান হয়েছেসিন্ডিকেটের হোতাদের শনাক্ত করে চাহিদার নিরিখে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়ও সমভাবেই গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা দেখছি, বাজারে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বহুলাংশেই অসাধুদের মাধ্যমে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটের কারণে। কাজেই ব্যবস্থাপনার গলদ না সাড়িয়ে অবস্থার উন্নতি আশা করা অতটা সমীচিন এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

  • অধ্যাপক, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা