× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সুন্দরবন

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ঘিরে মিউজিয়াম গড়ার গুরুত্ব

শেখ ইউসুফ হারুন

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪ ১১:০৫ এএম

শেখ ইউসুফ হারুন

শেখ ইউসুফ হারুন

২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ, ২০২৪ পর্যন্ত ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডসের আমন্ত্রণে দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা মৈত্রী স্কাউট ক্যাম্পে যোগদানের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কার্শিয়ং শহরে যাই। ‘সাদা অর্কিডের দেশ’ কার্শিয়ং শহরটি দার্জিলিং থেকে ৩৩ কিমি আগে অবস্থিত। একসময় এখানে সাদা অর্কিডের চাষ হতো। লেপচা ভাষায় ‘করসন’ শব্দের অর্থ সাদা অর্কিড। এ নাম থেকে কার্শিয়ং শব্দের উৎপত্তি। এটি দার্জিলিংয়ের একটি মহকুমা। দুটি ব্লক নিয়ে এ মহকুমাটি গঠিত। এ অঞ্চলটি ১৭৮০ সালের আগে সিকিমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর গোর্খারা সিকিম আক্রমণ করে এ অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৮১৪ সালে অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধে গোর্খারা পরাজিত হলে ইংরেজরা সিকিমের দখলকৃত ভূমি ফেরত প্রদান করে। ১৮৩৫ সালে সিকিম এক দানপত্রের মাধ্যমে দার্জিলিং পাহাড়ের ৩৬০ বর্গ কিমি এলাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে দেয়।


হিমালয় রিজিয়নে অবস্থিত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়-পর্বতের ওপরে নির্মিত কার্শিয়ং শহর যেন স্বপ্নের ভুবন। ওখানের গিদ্দা হিলে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস মিউজিয়াম। ১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে নেতাজিকে ছয় মাস এখানে গৃহবন্দি করে রাখে ইংরেজরা। তা ছাড়া ডাউহিল ফরেস্ট, ভুতুড়ে গির্জা, ভিক্টোরিয়া স্কুল, চা বাগান ও শ্যামলসুন্দর প্রকৃতি এ শহরকে করেছে মহিমান্বিত। সর্পিল আকারের রাস্তা দিয়ে যখন গাড়িগুলো পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে তখন শরীর ও মনে ভয়ের মৃদু শিহরন বয়ে যায়। মনে হয় আর হয়তো বাড়ি ফেরা হবে না। চালকের একটু অসাবধানতায় শেষ হয়ে যেতে পারে অমূল্য জীবন। এখানকার গাড়িচালকরা সুনিপুণ দক্ষতায় সমতলের মতোই খাড়া পাহাড়ে গাড়ি চালান। কারিগররা পাহাড়ের ঢালুতে অপূর্ব কর্মদক্ষতায় বাড়িগুলো এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেন বৃষ্টি-ঝড় বা পাহাড়ধসে সেগুলো গড়িয়ে না পড়ে। পাথর ও মাটি পরম মমতায় ঘরগুলো বুকে আগলিয়ে রেখেছে।

পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রা অনেক কঠিন। পাথুরে পর্বত হওয়ায় এখানে চা বাগান ছাড়া তেমন কৃষিকাজ হয় না। তবে পর্বতের ঢালে বিশাল বিশাল পাইন ও ওক গাছ পাথরের মাঝেও কীভাবে খাদ্য জোগাড় করে তা দেখে অবাক হতে হয়। বাপ্পী লাহিড়ির সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে’ গানের ‘ওদের বুঝিয়ে দাও সেই তুমি, পাথরেও ফুল যে ফোটাও’ লাইনটি শুনে মনে হতো পাথরে আবার ফুল কীভাবে ফোটে! কার্শিয়ং ভ্রমণ না করলে ঠিক বোঝা যাবে না পাথরে ফুল কীভাবে ফোটে। রাস্তার পাশে পাথরের গায়ে হলুদ, লাল রঙের হরেকরকম ফুল ফুটে আছে সারি সারি, দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। চাল, ডাল, শাকসবজি সমতল থেকে নিয়ে আসতে হয়। খাবার পানিও তেমন পাওয়া যায় না। পানি এখানে সোনার চেয়েও দামি। অনেক কষ্ট করে কীভাবে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট পাইপে করে ঝরনার পানি ঘরে ঘরে নেওয়া হয়েছে না দেখলে অনুমান করা যায় না।

ডিমোনোলজি বা ভৌতিকবিদ্যা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের জন্য ডাউহিল ফরেস্ট উর্বর স্থান। ডাউহিলের ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত রাস্তাটিকে বলা হয় ডেথ রোড বা মৃত্যুসড়ক। এক মুণ্ডুকাটা কিশোর কুয়াশাছন্ন রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। এ ছাড়া ভিক্টোরিয়া স্কুলে যাওয়ার পথে টিলায় উঠতে হলে ডানে একটি প্রাচীন গির্জা দেখতে পাওয়া যায়। লোকে একে হনটেড বা ভৌতিক গির্জা বলে। রাতের বেলা এ রাস্তা দিয়েও ধূসর চুলের এক বৃদ্ধাকে হাঁটতে দেখা যায়। চকিত দেখা দিয়ে আবার গহিন বনে উধাও হয়ে যায়। ভিক্টোরিয়া স্কুলটি শীতের চার মাস ছুটি থাকে। তখন রাতের বেলায় ছেলেদের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যায়। বড় বড় পাইন গাছে পরিপূর্ণ কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটলে অশরীরী আত্মার উপস্থিতি অনুভব করা যায় বটে। তবে মুণ্ডুকাটা বালক বা ধূসর চুলের বৃদ্ধা কাউকে কোনো অনিষ্ট করেছে বলে শোনা যায়নি।

ডাউহিল ফরেস্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ফরেস্ট মিউজিয়াম। এর পাশে রয়েছে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট স্কুল’। মিউজিয়ামটিও একই সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। সে অর্থে মিউজিয়ামটি প্রায় ১১৭ বছরের পুরোনো। মিউজিয়ামে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ, লগ, পাতা, ফুল, ফসিল ও পশুপাখির মৃতদেহ ট্যাক্সিডার্মি করে রাখা হয়েছে। এমনকি বনজ দ্রব্যাদি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, ঘর, অস্ত্রাদিও রাখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার বিলুপ্ত প্রাণীর চিত্রও সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় মিউজিয়ামটি সংরক্ষণ করা হলেও ডাউহিল ফরেস্টে যারা ভ্রমণ করেন তারা মিউজিয়ামটি না দেখে ফেরেন না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তা পেলে মিউজিয়ামটি আরও সুন্দর করে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা যেত।

সুন্দরবন আমাদের জাতীয় বনভূমি, যা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা নিয়ে বিস্তৃত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট; যা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। সুন্দরবন কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে কোনো পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠেনি। অনেক বিদেশি সুন্দরবন দেখতে আসেন। কিন্তু যাতায়াত, থাকাখাওয়া ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় তারা সুন্দরবন ভ্রমণ করতে পারেন না। অথচ সুন্দরবন হতে পারত বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবনাক্ততাসহ ক্ষুদ্রয়াতন দ্বীপমালা। এই অপরূপ প্রাকৃতিক দানকে পুঁজি করে আমরা আমাদের জিডিপিতে এর ব্যাপক  ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান করে তুলতে পারি। এ জন্য যাতায়াত, নিরাপত্তাসহ আরও কিছু দিকে গভীর মনোযোগ জরুরি। কার্শিয়ংয়ে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে ডাউহিল ফরেস্টের বনভূমি ও চা বাগান কেন্দ্র করে। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক কার্শিয়ং ভ্রমণ করেন। ওখানে থাকাখাওয়া ও নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই। মধ্য রাতেও নারীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন।

সুন্দরবনে একসময় বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর আবাসভূমি ছিল, যেগুলো আজ বিলুপ্ত। সুন্দরবনের উৎপত্তি, ভূপ্রকৃতি, নদ-নদীর গতিপ্রকৃতি, বৃক্ষ ও গুল্মাদি, জীবজন্তু, পশুপাখি, জলচর প্রাণী, বিলুপ্তির কারণ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির ওপর গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুন্দরবন দেশি-বিদেশি গবেষক ও পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এখান থেকে গবেষণা বা তথ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে সুন্দরবন কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি কোনো মিউজিয়াম। একটি মিউজিয়াম থাকলে অনেক গবেষক এখান থেকে সহজেই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম ছোট আকারে একটি মিউজিয়াম পরিচালনা করলেও সেখানে এককভাবে সুন্দরবন তেমন গুরুত্ব পায়নি। ব্রিটিশ আমলেও সুন্দরবন কেন্দ্র করে কোনো মিউজিয়াম গড়ে ওঠেনি।

সুন্দরবনের ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের জন্য একটি মিউজিয়াম নির্মাণ করা প্রয়োজন। সুন্দরবনের কাছাকাছি স্থানে বা খুলনা শহরেও এটি স্থাপন করা যেতে পারে। এখনও অনেক তথ্য সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে। তা না হলে প্রকৃতির নিয়মেই এখান থেকে ৫০ বছর পরে অনেক তথ্য, প্রমাণ বা নিদর্শন হয়তো পাওয়া সম্ভব হবে না। সুন্দরবনের ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কথা আগেই বলেছি। এই প্রেক্ষাপটে তো বটেই আমাদের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করেও সুন্দরবনকেন্দ্রিক মিউজিয়াম গড়ে তোলা আবশ্যক। তা না হলে  বিস্মৃত হয়ে যাবে অনেক ইতিহাস, স্মৃতি, গল্প, জানা-অজানা কাহিনী। এখনই সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কেন্দ্র করে একটি মিউজিয়াম নির্মাণের। বন অধিদপ্তর ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখবে আশা করি।

  • নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা