মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ
ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৫ এএম
ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ফের প্রকট রূপ নিয়েছে। ৩০
মার্চ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর
তিন সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইতঃপূর্বে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর
পালিয়ে আসা সদস্যদের ফেরত পাঠানো হলেও সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে আবার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
ফলে জাতীয় নিরাপত্তার আঙ্গিকে নতুন করে কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের গৃহদাহ উৎকট
পর্যায়ে রয়েছে এ কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। দেশটিতে জান্তা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা
ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে এবং অনেক স্থানে তারা আত্মসমর্পণও করছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে
জান্তা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশ সীমান্তে
অনুপ্রবেশ করছে। তবে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর পালিয়ে আসা কিংবা
অনুপ্রবেশ অনেকাংশেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেই মনে করি। এখন পর্যন্ত বিষয়টি আমাদের
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমনকি কূটনৈতিক চ্যানেলের
মাধ্যমেও এ-সংক্রান্ত যেকোনো সংকট মোকাবিলার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দুর্গম হওয়ায় নিরাপত্তাজনিত বাড়তি কিছু সংকট থেকে যায়।
মিয়ানমারে ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে
বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলে
সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই অবস্থান করতে পারে। যদি তা করা হয় তাহলে আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তার
জন্য বাড়তি সংকট তৈরি করবে। আমাদের জন্য সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়টি এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ সীমান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় আশ্রিত রোহিঙ্গারা আতঙ্কে রয়েছে। শুধু তাই নয়,
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়ও শঙ্কা-উদ্বেগে দিন কাটাতে হচ্ছে অনেককে। এসব বিষয় বিবেচনায়
রাখা জরুরি।
বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ-উখিয়াসহ
বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে। বাংলাদেশ বছরের পর বছর এ বোঝা বহন করে চলেছে। মিয়ানমারে সৃষ্ট
নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা সুযোগ নিতে পারে এমন অভিযোগ উঠেছে
বিভিন্ন মহল থেকে। আরাকান আর্মির সঙ্গে এখন শুধু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাতই নয়, এরই
মধ্যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের সংঘাতের খবরও পাওয়া গেছে। এ প্রেক্ষাপটে রাখাইনের
রোহিঙ্গারা সেখানে প্রতিবাদ সমাবেশের পাশাপাশি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এ
অভিযোগ নতুন নয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কিছু বিপথগামী
অস্ত্র কেনাবেচা, মাদকসহ বহুমুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। প্রশ্ন
হচ্ছে, এত কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে কীভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবৈধ
অস্ত্র ও মাদক এবং সন্ত্রাসীর অনুপ্রবেশ ঘটছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই
বেশি। সচরাচর যুদ্ধক্ষম বা ফাইটিং ফোর্স বলে যে বয়সিদের ইঙ্গিত করা হয় তাদের হাতে অস্ত্র
এলে তা অবশ্যই শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিতদের হাতে অবৈধ
অস্ত্র এলে তা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
রোহিঙ্গা
ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে
অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অবসানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে
দুটি পৃথক ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। প্রথমত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়
কড়া নজরদারি চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য আলাদা নজরদারি চালু
করতে হবে। এ দুটি ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেকোনো ঘটনার
প্রভাব রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও পড়ছে। আমরা দুটিকে আলাদাভাবে দেখলে সমাধান পাব না। আমাদের
এ বিষয়ে সমন্বয়মূলক ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হবে।
মিয়ানমারে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সহসাই এর
নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্ত এলাকাজুড়ে
নানানরকম শঙ্কার ছায়া ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। মিয়ানমারের যুদ্ধজাহাজ নাফ নদে আসার খবরও
সংবাদমাধ্যমেই জানা গেছে। কিন্তু বিশ্বের বৃহৎ শক্তি যেমন চীন, জাপান, ভারত ইত্যাদির
সঙ্গে মিয়ানমারের অর্থনৈতিকসহ বহুমাত্রিক যে সম্পর্ক রয়েছে এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান
পরিস্থিতির নিরসন ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ মিয়ানমার গঠনে তাদের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা
লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমরা জানি, মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশটির
জান্তা সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই চলছে। শুরুতে জান্তা সামরিক বাহিনী চীনের
পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এ যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিলÑএমন একটি ধারণা সবার ছিল। চীনের
মদদেই মূলত জান্তা সরকার মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে
পেরেছে।
চীনের সহযোগিতা পাওয়ায় জান্তা সরকার কাউকে সমীহ
করেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বহুবার আলোচনার
চেষ্টা করলেও তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। মিয়ানমার বরাবরই এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখিয়েছে।
এত দিন জান্তা সরকারের অনেকের ধারণাই ছিল, তাদের সহযোগিতার জন্য চীন সব সময় প্রস্তুত।
যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে চীনের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা তারা পাবে। আরাকান আর্মি
ও মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দাপটে মিয়ানমারের অনমনীয় এ ভাবমূর্তিতে ফাটল
ধরতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑসশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দাপটের নেপথ্যে কারা অবস্থান
করছে? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অনেকের দীর্ঘদিন ধারণা ছিল, এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা কোনো মহল
পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে। চীন যেহেতু জান্তা সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করছে সেহেতু ভিন্ন
একটি মহলের দিকেই সন্দেহের তির বিদ্ধ হচ্ছিল।
বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো স্বার্থ থাকতে পারে। কারণ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাংগঠনিক
কার্যক্রম মিয়ানমার সীমান্তের বাইরেও রয়েছে। তাদের পেশাজীবী, আঞ্চলিক ও প্রবাসী বিভিন্ন
সংগঠন তৈরি করেছে। ছায়া সরকারের মতোই বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনও বিদ্রোহী সশস্ত্র
গোষ্ঠীর সদস্যরা তৈরি করেছে। যেহেতু এ সংগঠনগুলোকে পশ্চিমা বিভিন্ন সংগঠন সহযোগিতা
করছে তাই এমন অনুমান সঙ্গত। অথচ সাম্প্রতিক নানা তথ্যে বলা হয়েছে, চীন সরাসরি বিদ্রোহী
সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদেরও সহযোগিতা করছে। মিয়ানমারে গুপ্তচর বাহিনীর সহযোগিতায় তারা
দুই পক্ষের সঙ্গেই এক ধরনের কৌশলী সম্পর্ক ধরে রেখেছে। ফলে মিয়ানমার ঘিরে ভূরাজনীতির
জটিল সমীকরণ নানাভাবে আমাদের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরই মিয়ানমারের
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান রেখেছে এবং এবারও জাতীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণ করাই
আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
মিয়ানমারে পরিস্থিতি এখন বহুমাত্রিক জটিল, এও
বলা যায়। জটিলতা বাড়ছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। রোহিঙ্গা ইস্যু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের
ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বিশেষত সীমান্ত নিরাপত্তার
ক্ষেত্রে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই। কোনো একটি মহল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে পরোক্ষভাবে প্রভাব খাটিয়ে চলেছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য, এ অভিযোগ উড়িয়ে
দেওয়ার নয়। তবে কে বা কারা তা করছে এবং কীভাবে করছে বলা কঠিন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের
ব্যাপারেও ওই দেশগুলোর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ মিয়ানমারের
বন্ধুরাষ্ট্র প্রায় সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কও অত্যন্ত মজবুত। তার
পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তাদের নিষ্ক্রিয়তা ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মেরুকরণের
সমীকরণ অবশ্যই। এ ক্ষেত্রে আপাতত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।
আবারও বলি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের গাঢ় ছায়া যেন আমাদের ওপর আর না পরে সেজন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প নেই। আমি নিজে শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে আফ্রিকায় ছিলাম। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ৯ থেকে ১৭ বছর বয়সি গ্রুপের অধিকাংশের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। বাস্তবিক পরিণতি সম্পর্কেও তাদের অভিজ্ঞতা তত পুষ্ট নয়। এজন্য অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে এ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে পারে অশুভ মহল। দেশের অভ্যন্তরে কোনো মহল যেন সে কাজ করতে না পারে সেদিকে মনোযোগ বাড়ানো জরুরি। মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট যেমন একদিনে সৃষ্ট নয় তেমনি এর সমাধানও এত সহজে হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমাদের জন্য তা কোনো না কোনোভাবে বাড়তি উপসর্গ তৈরি করছে তা তো ফিরে ফিরে দৃশ্যমান হচ্ছেই। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব দরবারে নুতন করতে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি কূটনৈতিক চ্যানেলে। ক্ষমতাধর দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।