জীববৈচিত্র্য
মো. অহিদুর রহমান
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৩ পিএম
জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস,
প্রাণীর খাদ্যসংকট, দুর্বল আইন, চোরা শিকারি, হাওর জলাভূমি ও নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভূমিতে
অতিরিক্ত বিষপ্রয়োগ, বন্য প্রাণী নিয়ে বাণিজ্য ও মানুষের নির্দয় ব্যবহারের কারণে প্রকৃতি
ও মানবজাতির জন্য জরুরি এই প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি বড় বড় প্রাণী
বাঁচলেই কি প্রকৃতি বাঁচবে? আমরা বাঘ, হাতি, হরিণ, কুমির এসব প্রাণীর কথা যত ভাবি অন্যসব
প্রাণীর কথা তত চিন্তা করি না। কিন্তু সকল প্রাণের অস্তিত্ব যে আমার প্রকৃতি ও পরিবেশের
জন্য গুরুত্বপূর্ণ, মানবজাতির জন্য একান্ত প্রয়োজন, তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। প্রাণের
বৈচিত্র্যই আমাদের জীবন, উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্য আছে বলেই আমাদের জীবন
এত সুন্দর। এই বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, শ্রদ্ধাবোধের জায়গা তৈরি ও আমাদের
জীবনের জন্যই টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন বন ও বন্য প্রাণী। প্রতিবছর ৩ মার্চ পালন করা
হয় বন্য প্রাণী দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল, মানুষ ও গ্রহের সংযোগ : বন্য প্রাণী
সংরক্ষণে ডিজিটাল উদ্ভাবন অন্বেষণ। আইইউসিএর এক সমীক্ষামতে, বাংলাদেশে ১১৩ প্রজাতির
স্তন্যপায়ী, ৬৩০ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৬১ প্রজাতির
মিঠাপানির মাছ, ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণ, ৩২৭ প্রজাতির শামুক ঝিনুক, ৬৬ প্রজাতির
কোরাল, অসংখ্য পোকামাকড়, ৫ হাজার প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদÑ যার ভেতর ১৬০ প্রজাতির শস্য
রয়েছে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশি ধানের জাত নামে একটা বইয়ে ১২
হাজার ৪৮৭টি স্থানীয় জাতের ধানের নাম উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া অপর এক সমীক্ষা থেকে ৩ হাজার
৬৪৫ জাতের পাটজাতের বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে।
বনই হচ্ছে প্রাণীর জন্ম, বিচরণ, প্রজনন ও বসবাসের উপযুক্ত জায়গা।
দেশের জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ভান্ডার হচ্ছে বন; যা প্রাণীর অবাধ মিউজিয়াম। বনই হচ্ছে
জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের ধারক ও বাহক। বন আছে বলেই উদ্ভিদ ও প্রাণী বেঁচে আছে। বন
শুধু গাছপালাই রক্ষা করে না, প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক উন্নত জাতের ফসল উদ্ভাবনের
জন্য বন্য প্রজাতির ফসলের জিন সংগ্রহ করা হয়। বন ধ্বংসের প্রধান কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা
বৃদ্ধি। জ্বালানির চাহিদা পূরণ করছে বনের কাঠ দিয়ে, বসতবাড়ি নির্মাণ, ফসল চাষাবাদ,
রাস্তাঘাট নির্মাণ, নগরায়ণ, জুমচাষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃক্ষের পরিচর্যার অভাব, পরিবেশদূষণ,
পাহাড় কাটা, পাহাড় ধ্বংস, বৃক্ষের রোগ, বনবিধি অমান্য করাসহ বিভিন্ন কারণে বন ধ্বংস
হচ্ছে।
কৃষি, নগরায়ণ, বন উজাড়সহ মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাকৃতিক আবাসস্থল
ধ্বংস ও ক্ষতি হয়। বাসস্থানের এই অভাবের কারণে অনেক প্রজাতির বেঁচে থাকা, প্রজনন করা
ও খাদ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। শিল্প, কৃষি ও বর্জ্য থেকে উদ্ভূত দূষণ দ্বারা
বায়ু, জল ও মাটি দূষিত হয়। রাসায়নিক, প্লাস্টিকের আবর্জনা ও কীটনাশক প্রাণীর স্বাস্থ্যের
জন্য খারাপ। কারণ এসব আবাসস্থলকে ধ্বংস করে এবং সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে। বিশ্বব্যাপী
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্য প্রাণী ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। গত পাঁচ দশকে বন্য প্রাণীর
সংখ্যা ৬৫ শতাংশ কমেছে। প্রতিবছর কমার পরিমাণ ২ শতাংশ, এ হারে কমতে থাকলে ২০৩০ সাল
নাগাদ বিশ্বের ৮০ শতাংশ বন্য প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে পরিবেশবাদী
সংগঠন ওয়ার্ল্ড জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের যৌথ
গবেষণাপত্রে। এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে ৫৮ শতাংশ বন্য প্রাণী হারিয়ে গেছে।
এর মধ্যে নদ-নদী, হ্রদ ও জলাভূমিতে থাকা জীবজন্তুই বেশি পরিমাণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জলবায়ু
পরিবর্তন বন্য প্রাণীর ওপর নতুন বিপত্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন
বিশেষজ্ঞরা। বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া বন্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে
বড় হুমকিগুলোর একটি। জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক কারণে বনাঞ্চলে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত
বৈধ-অবৈধ হস্তক্ষেপের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমে যাচ্ছে বন্য প্রাণীর
আবাসস্থল। দেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ১১টি প্রজাতি ইতোমধ্যেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন
হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৪৫টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।
কত প্রাণীই ক্রমাগত বিলুপ্ত হচ্ছে। মেছো কুমির অতি বিপন্ন অবস্থায়
টিকে আছে। কচ্ছপ প্রজাতির মধ্যে বড় কাইটা, কাছিম, হলুদ পাহাড়ি কাছিম অতি বিপন্ন। সাপের
মধ্যে নির্বিষ গুলবাহার অজগর, বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়া অতি বিপন্ন এবং কালকেউটে, গোখরা,
ভাইপার, কালনাগিনী, দুধরাজ, সবুজ ডোরা প্রভৃতি বিপন্ন সাপের তালিকায় রয়েছে। ডোরাকাটা
হায়েনা রাজশাহী অঞ্চলে, ধূসর নেকড়ে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে, নীলগাই দিনাজপুর-পঞ্চগড়
এলাকায়, বান্টিং বা বনগরু চট্টগ্রাম ও সিলেটে এবং বনমহিষ দেশের সব বনাঞ্চলেই দেখা যেত।
এ ছাড়া তিন ধরনের গন্ডার ছিল বাংলাদেশেÑ সুমাত্রা গন্ডার, জাভা গন্ডার ও ভারতীয় গন্ডার।
বাদা বা জলার হরিণকে স্থানীয়ভাবে বলা হতো বারো শিঙা হরিণ। সিলেট ও হাওর এলাকায় দেখা
যেত। কৃষ্ণষাঁড় নামে একটি প্রাণী ছিল রাজশাহী ও দিনাজপুর এলাকায়।
মহাবিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় রয়েছে বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, বনগরু, সম্বর হরিণ, বানর, হিমালয়ান ডোরা কাঠবিড়ালি ও কালো ভল্লুক। লালমুখ দাগিডানা সিলেটে পাহাড়ি বাঁশঝাড়ে বাসা বাঁধত। বিশেষ জাতের পাহাড়ি বাঁশঝাড় প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় পাখিরাও এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার একেকটি সারস বাংলার নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। জলাভূমির শামুক ও ঝিনুক ছিল এদের খাবার। মূলত শিকারিদের কবলে পড়ে এই বিশাল পাখি হারিয়ে গেছে। দেশে বর্তমানে ২৬৮টির মতো দেশি শকুন আছে বলে সর্বশেষ তথ্যমতে জানা যায়। তারপরেও মাঝে মাঝে শকুনের লাশগুলো পাওয়া যায় বনের মাঝে। অসুস্থ শকুন লোকালয়ের কাছে এসে পড়ে থাকে, যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বাংলার বিখ্যাত বালিহাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিলা বা মদনটাক, ধলাপেট বক, সাদাফোঁটা গগন রেড, রাজ শকুন, দাগি বুক টিয়াঠুঁটি, লালমাথা টিয়াঠুঁটি, গাছ আঁচড়া, সবুজ ময়ূর চিরতরে এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। প্রাণের এই বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই।