সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৯ পিএম
আমাদের অর্থনীতির
জোগানদার সুনির্দিষ্ট কিছু খাত রয়েছে। এর অন্যতম রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। আমরা জানি,
একসময় বহির্বিশ্বে আমাদের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ছিল। এখন এর পরিসর অনেক
বিস্তৃত। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, মালয়েশিয়া ছাড়াও ইউরোপ-উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা
এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এখন আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত। কিন্তু সে অনুপাতে প্রবাসী
আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসছে না, বরং কমছে। ‘তিন কারণে কমছে রেমিট্যান্স’ শিরোনামে ৫
এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের গর্ভে প্রবাসী আয় দেশে আসার হার
তুলনামূলকভাবে কেন কমছে এ তথ্যও উঠে এসেছে। আমরা জানি, ঈদুল ফিতর-ঈদুল আজহা সামনে রেখে
দেশে প্রবাসী আয় আসার হার তুলনামূলক বাড়ে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন পরিস্থিতি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড পরিমাণ আসার পর মার্চে তা
না বেড়ে উল্টো কমেছে। দেশে ডলারের চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন প্রবাসী আয়ে এমন ভাটা আমাদের
উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
প্রবাসী আয় নিম্নমুখী
হওয়ায় রিজার্ভ চাপের মুখে পড়েছে এবং এর নেপথ্যে তিনটি অন্তরায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের
অভিমত। তাদের মতে, প্রথমত, হুন্ডির লাগাম টানতে না পারা; দ্বিতীয়ত, নির্ধারিত দরের
পরও আনুষ্ঠানিক যে দর ছিল তা কমে যাওয়া বা বাড়তি প্রণোদনা দিতে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ
এবং তৃতীয়ত, ঈদের আগে অন্য বছরের তুলনায় এবার প্রবাসীদের কম পরিমাণে আয় পাঠানো। এ সম্পাদকীয়
স্তম্ভেই আমরা নিকট অতীতে বলেছি, প্রবাসী আয় হুন্ডিচক্রের গ্রাসমুক্ত করতেই হবে। আমরা
দেখছি, জনশক্তি রপ্তানি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে কিন্তু সে অনুপাতে প্রবাসী আয় বাড়েনি। আমরা
জানি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের তরফে বৈধ পথে যেন প্রবাসী আয় আসে এজন্য অনেক উদ্যোগ
নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর
সুফল মিলছে না। ইতঃপূর্বে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল,
অর্থ পাচারকারীদের ছত্রছায়ায় মধ্যপ্রাচ্যের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও বিস্তৃত হয়েছে
হুন্ডির জাল। এর প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের
আরও কয়েকটি দেশ। সেসব দেশে শত শত প্রতিষ্ঠান গড়ে এর আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা করছেন অর্থ
পাচারকারীরা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ ইউরোপের পর্তুগাল এখন হুন্ডিচক্রের নতুন
গন্তব্য। প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সরকারের দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন
হিসেবে আখ্যায়িত হলেও এ ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে বেশ কিছু ব্যাংক।
সহজেই প্রতীয়মান
হয়, হুন্ডিচক্রের আগ্রাসি থাবায় অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ অভিঘাত লাগছে। অনেক অর্থনীতিবিদই
বলেছেন, হুন্ডির পথ রুদ্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব ভয়াবহ হয়ে উঠবে এবং
তা জিডিপিতেও বড় অভিঘাত ফেলবে। অর্থপাচার ব্যাধির সংক্রমণ এখন এতটাই ব্যাপকভাবে ঘটেছে
যা দুর্ভাবনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এও জানি, অসাধু রাজনীতিক
ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহন হিসেবে হুন্ডিচক্র সক্রিয়। আরও অভিযোগ আছে, আমদানি-রপ্তানির
আড়ালেও বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশে দেশের কয়েকটি শিল্প গ্রুপ সাম্রাজ্য
গড়ে তুলেছে। ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমে আরও বলা হয়, কিছু শিল্পগ্রুপ দেশে তাদের প্রতিষ্ঠান
চাঙা না করে অর্থ পাচার করে বিদেশে এর ভিত শক্তিশালী করতে সক্রিয় রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির
প্রেক্ষাপটে এও সহজেই প্রতীয়মান হয়, হুন্ডিচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া ভিন্ন
গত্যন্তর নেই। প্রবাসী আয় দেশে আসার হার বাড়াতে হলে একদিকে যেমন প্রবাসীদের বহুমাত্রিক
সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে তেমন আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায়ও সমভাবেই গুরুত্ব
দিতে হবে।
গত বছর ডিসেম্বরে
বিশ্বব্যাংক ও অন্য একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে নেতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হলেও এজন্য
যে কিছু উপসর্গ বিদ্যমান তা নিরসন করতে পারলে প্রবাসী আয় বাড়ার পাশাপাশি রিজার্ভ স্ফীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির দুরবস্থায়ও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী
আয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে এর নজির আমাদের সামনেই রয়েছে। বিভিন্ন
প্রক্রিয়ায় বৈধ পথে যাতে অধিক হারে প্রবাসী আয় দেশে আসে এবং এর ফলে দেশের অর্থনীতি
চাঙা হয় সে লক্ষ্যে সরকার প্রণোদনা-সুবিধাদির যে দরজা খুলে দিয়েছে সেেই দরজা কেন এবং
কীভাবে রুদ্ধ হয়ে পড়ছে তা অস্পষ্ট নয়। এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, যেহেতু কারণগুলো
অচিহ্নিত নয় সেহেতু সমস্যার সমাধানও দুরূহ নয় বলেই। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
সব পক্ষকে যথাযথভাবে কাজের কাজটি করতে হবে। আমরা দেখেছি, ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া প্রবাসী
আয়ে জোয়ারের ক্ষেত্রে অনেকটাই অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। অনেক অর্থনীতিবিদ এও বলেছেন, মুদ্রা
বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা যথাযথ করার পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে যাতে প্রবাসীরা তাদের
আয় পাঠান এ ব্যাপারে বহুমুখী কর্ম উদ্যোগ নিয়ে তাদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নজর
দিতে হবে হুন্ডিচক্রের উৎসে। আবার কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মোবাইল ব্যাংকিংকেও দায়ী করেছেন।
আমরা জানি, ডলারের
বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার কারণে হুন্ডির হোতারা অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা প্রবাসীদের
বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিক জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করছেন। আমরা মনে করি, প্রবাসী
আয় দেশে আসার হার বাড়াতে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউসের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের যে নির্দেশনা রয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে
প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতাবোধ অধিকতর পুষ্ট করে তাদের বোঝাতে হবে, হুন্ডি পুরোপুরি অবৈধ।
বিদেশে হুন্ডিচক্রের সন্ধানে দূতাবাসগুলোকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার মনে
রাখা বাঞ্ছনীয়, দেশপ্রেম সামগ্রিক উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। দেশ সংকটে পড়লে
সবাইকেই কমবেশি ভুগতে হবে।