× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কেএনএফের হামলা

সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি বহুমাত্রিক অনুসন্ধান জরুরি

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৫৯ এএম

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংক ডাকাতির পর পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ একটি থানায় হামলা চালায়। কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলছিল এবং তারা কথা দিয়েছিল সন্ত্রাসী কার্যক্রমে আপাতত জড়াবে না। কিন্তু তাদের এই অঙ্গীকারের মাত্র এক মাসের মধ্যেই বড় ধরনের চারটি ঘটনা ঘটেছে। আমরা দেখেছি, যখনই এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা হয়, তখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি অংশ পুরোপুরি একমত হতে পারে না। এ ধরনের সংগঠনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের মতভিন্নতা থাকাটাই সংগত। আর যাদের মতভিন্নতা থাকে, তারাই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পক্ষে থাকে না। বিশ্বের প্রায় সবখানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের অনেক সদস্য শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও অশান্ত কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। প্রথম যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আলোচনা হয়, তখন আমিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ ছিলাম। তখনও দেখেছি, একটি অংশ আগ্রহী হলেও অন্য একটি অংশ সহযোগিতা করতে রাজি হতো না। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে কাজ করতে গিয়েও একই চিত্র দেখেছি। কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হলে একটি অংশ সোৎসাহে সহযোগিতা করলেও অন্য অংশ প্রথম থেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাত। বিশেষত যারা ওই অঞ্চলে চাঁদাবাজি বা অন্য কোনো পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করে, তাদের স্বার্থে আঘাত লাগছে বিবেচনা করে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগকারীরা তাদের স্বার্থ বিবেচনায় শান্তি আলোচনা ভণ্ডুল করার চেষ্টা করে থাকে।


থমথমে বান্দরবানে আবার হামলার আশঙ্কায় তটস্থ সাধারণ মানুষ। পাহাড়ে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘পাহাড়ে যৌথ অভিযান চলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’ অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, ‘বিদেশি সহযোগিতা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে কেএনএফ।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছিল তাদের অস্ত্রশস্ত্রও কেএনএফের কাছে এসেছে বলে জানা গেছে।’ ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য আশাব্যঞ্জক হলেও ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার আগে বলেছেন, ‘কেন হঠাৎ করে কুকি-চিন এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। তবে যে উদ্দেশ্যেই তারা এসব করুক না কেন আমরা তাদের কাউকে ছাড় দেব না।’ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের কঠোর অবস্থান সাধুবাদযোগ্য। তবে আরও গভীর গোয়েন্দা কার্যক্রম জরুরি বলে মনে করি।

‘বৃক্ষ তুমি কী, ফলে পরিচয়’Ñ বাংলা এই প্রবাদটিই মূলত আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সংযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বান্দরবান বা পার্বত্যাঞ্চলে কঠোর নিরাপত্তা ও নজরদারি প্রত্যাশিত ছিল। মিয়ানমারে গৃহদাহের আঁচ লেগেছে আমাদের দেশেও। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কঠোর নজরদারি তখন থেকেই বাড়ানো হয়। মিয়ানমারে উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের প্রত্যেকে শুরু থেকে একটি বিষয়ে ব্যাপক জোর দিয়েছিলেন। সেটি হলো, সীমান্তবর্তী হওয়ায় বান্দরবান অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি জায়গা। নিরাপত্তাব্যবস্থায় সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতির ফলে যেকোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কাও করেছিলেন অনেকে। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশÑ এই তিনটি দেশের ক্ষেত্রেই এমনটি প্রযোজ্য। পার্বত্য ও জঙ্গলাবৃত এলাকা হওয়ায় নানা ফাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কর্মীরা পালিয়ে যেতে পারে। যখন তারা ফাঁকফোকর দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়, তখন আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ধরতে পারেন না। এটি মূলত সীমান্তবর্তী দেশগুলোর জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই এসব অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গাফিলতির অবকাশ নেই। মিয়ানমারে সৃষ্ট গৃহদাহের প্রেক্ষাপটে অতীতে একাধিকবার জান্তা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তৎপরতা বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে পাহাড়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা জরুরি।

মিয়ানমারের প্রেক্ষাপট ক্রমেই পাল্টাচ্ছে। এই সময়ে যদি অবস্থার আরও অবনতি ঘটে, তাহলে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারেÑ কারও কারও এই আশঙ্ক অমূলক নয়। যদি তাই হয়, তাহলে তখন আবার নতুন করে পাহাড়ে আশ্রয়প্রার্থীর ঢল বাড়বে। শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন থানচি ও রুমায় ছিলাম। ওই ‘অপারেশন দাবানল’-এর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিলাম। বান্দরবানে যে ঘটনা ঘটেছে তা এড়ানো কঠিন কিছুই ছিল না। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি এক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল দেখাতে পারেনি। বান্দরবানের মতো স্পর্শকাতর একটি জায়গায় কঠোর, অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে গোয়েন্দা তদারকি ও নজরদারির বিকল্প নেই। গোয়েন্দা নজরদারির ক্ষেত্রে কৌশলগত অবস্থান নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের শীর্ষরা বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের ব্যতীত অন্যদের আলাদা শনাক্ত করার উপায় নেই। তারা মানুষের ভিড়ে আত্মগোপন করে থাকে। যেহেতু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নিজস্ব ইউনিফর্ম নেই বা তাদের হঠাৎ চিহ্নিত করা যেমন কঠিন, তেমনি কোনো আলামতও পাওয়া যায় না। তাই এদের শনাক্ত করার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো জরুরি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গোয়েন্দারা ওই এলাকায় বিভিন্ন ভেক ধারণ করে দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি রাখেন। তাদেরও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যেতে হয়। পার্বত্য অঞ্চলে অবশ্যই বিষয়টি কঠিন। কিন্তু থানচিতে কেএনএফের অপতৎপরতার ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট, গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে পারেননি।

যেকোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন চাইলেই নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাছাকাছি হামলা চালাতে পারে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। আর এই তথ্য সংগ্রহের কাজটি করার জন্য তারা দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দারা যদি নজরদারি বাড়াতে পারতেন, তাহলে অবশ্যই খবর সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিতে পারতেন। বিশেষত বান্দরবানের ওই এলাকাতে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান রয়েছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির বিষয়টিকেই বড় করে দেখতে হয়। পার্বত্য অঞ্চলে সেনাসদস্যদের পাঠানো হলে তাদের বাড়তি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। পার্বত্য অঞ্চলে দায়িত্বপালন করা কঠিন অবশ্যই। তারপরও যেহেতু তাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাই তাদের দায়িত্বপালনে অধিকতর সজাগ থাকাই বাঞ্ছনীয়। বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার ক্ষেত্রে ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিতরা তাদের দায়িত্বপালনে ঘাটতির বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়া অমূলক নয়। এখন প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক কিছুই জানা সম্ভব। কীভাবে কোন সংগঠন গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে বা যোগাযোগ করছে তা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সহজেই জানা সম্ভব। তা করা হয়েছে কি-না সেটিও বড় প্রশ্ন। পাহাড়কে অশান্ত করার পেছনে দেশি-বিদেশি অপশক্তির ইন্ধন রয়েছে কি-না তা এখনই বলা কঠিন। তবে পাহাড়ে কেএনএফের ঘটনার পর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি বহুমাত্রিক অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি।

বান্দরবানে ডাকাতির ঘটনার পাশাপাশি রামপাল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন আনসার সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে ঢাকায় মেট্রোরেলের গুদামেও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ঈদের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বছরে দুটো বড় উৎসবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকেই ছুটিতে থাকেন। তখন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। আবার ঈদের সময় অনেকেরই কিছু বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ভালো নেই, তিক্ত এই সত্য অস্বীকারেরও উপায় নেই। জীবিকা নির্বাহের সামান্য অবলম্বন না পেয়ে অনেকেই সামাজিক অপরাধে যুক্ত হচ্ছে- এ অভিযোগ অসত্য নয়। ঈদের আগে সড়কে ছিনতাই, ডাকাতি হয়, এমন অভিযোগ পুরোনো। কারণ ঈদে সবারই একধরনের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও এ সময় সব জায়গায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বান্দরবানের ঘটনার সঙ্গে অবশ্য মেট্রোরেলের গুদামে ডাকাতির বিষয়টিকে মিলিয়ে দেখার কারণ আছে বলে মনে করি না। বরং এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই বিশ্লেষণ করতে চাই। বান্দরবানের বিষয়টিকে পার্বত্য অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা উচিত এবং সমতলের ঘটনাগুলো সমতলের প্রেক্ষাপটেই বিচার করা শ্রেয়। তবে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে-সমতলে অভিযান চালানোর প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে।

  • অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা